
ডিমের ক্রমাগত দরপতনে ক্রেতারা স্বস্তিতে থাকলেও দিশেহারা টাঙ্গাইলের খামারিরা। খামারিদের দৈনিক লোকসান হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা। প্রতিনিয়ত লোকসানে গেল একযুগে জেলায় ডিমের উৎপাদন কমেছে অন্তত ৬০ শতাংশ। তবে, দাম কমলেও কমেনি উৎপাদন খরচ। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডিম সংরক্ষণ ও রপ্তানির উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি দাম নির্ধারণ করে দেয়ার দাবি খামারিদের।
ডিমের ক্রমাগত দরপতনে ক্রেতারা স্বস্তিতে থাকলেও দিশেহারা টাঙ্গাইলের খামারিরা। খামারিদের দৈনিক লোকসান হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা। প্রতিনিয়ত লোকসানে গেল একযুগে জেলায় ডিমের উৎপাদন কমেছে অন্তত ৬০ শতাংশ। তবে, দাম কমলেও কমেনি উৎপাদন খরচ। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডিম সংরক্ষণ ও রপ্তানির উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি দাম নির্ধারণ করে দেয়ার দাবি খামারিদের।
টাঙ্গাইলের কালিহাতীর দেউপুর গ্রামের খামারি জিন্নাহ। নিজের জমানো ও ঋণের প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ করে তিন হাজার লেয়ার মুরগির খামার করেছেন। প্রতি পিস ডিম উৎপাদনে তার খরচ হচ্ছে ১০ টাকার বেশি। কিন্তু, বিক্রি করতে হচ্ছে পৌনে ৮ টাকায়। এতে দৈনিক আড়াই হাজার ডিম উৎপাদনে তার লোকসান প্রায় ৫ হাজার টাকা।
জিন্নাহ বলেন, ‘নিজেরা কাজ করেও কোনভাবেই লস পোষাতে পারছি না।’
জিন্নাহর মতো জেলার অন্যান্য খামারিদের অবস্থাও একই। গেলো রমজানের শুরু থেকে সরবরাহ বাড়া ও চাহিদা কমায় দরপতন শুরু হয়। গেলো কয়েক সপ্তাহে জেলায় খামার পর্যায়ে প্রতি হালি ডিমের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ৩২ টাকায়। ডিমের দাম কমলেও ফিডসহ ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় প্রতি পিস উৎপাদনে লোকসান গুণতে হচ্ছে দুই থেকে আড়াই টাকা। সে হিসেবে জেলায় আড়াই হাজার খামারে দৈনিক ৪০ লাখ পিস ডিম উৎপাদনে লোকসান প্রায় কোটি টাকা।
খামারিরা জানান, যখনই ডিমের দাম একটু বাড়ে, প্রশাসন আমাদের চাপ প্রয়োগ করে ৮ টাকায় ডিম বিক্রি করার জন্য। অথচ আমাদের একটা ডিমের জন্য খরচ হয় প্রায় ১০ টাকা ২০ পয়সার মতো। খাবারের দাম, বিদ্যুৎ বিল, লেবার খরচ সবকিছু মিলিয়ে আমরা ধ্বংসের মুখে পড়ে যাচ্ছি।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এক যুগ আগে জেলায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ডিম উৎপাদন হতো। ক্রমাগত লোকসান ও নানামুখী সমস্যায় উৎপাদন কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের দাবি পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম কমলেও বিক্রি বাড়েনি। উল্টো আগের চেয়ে বিক্রি কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগে যেখানে ডিমের ডজন ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায় বিক্রি হতো তা এখন বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। কোরবানি ঈদে ক্রেতারা ডিম কম কেনায় ডিমের স্টক বেড়ে গেছে। এ কারণে ডিমের দাম কমে গেছে। আগের মতো ডিম বিক্রি হয় না এখন। আমদানি বেশি কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে কম।
খামারিদের লোকসান কমাতে ন্যুনতম দর নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। আর খামার টিকিয়ে রাখতে সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখতে না পারলে ডিম উৎপাদন খাত চলে যাবে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। তখন প্রোটিনের ঘাটতি পূরণের সবচেয়ে সহজলভ্য পণ্যটি কিনতে হবে চড়া দামে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সঞ্জয় কুমার সাহা বলেন, ‘এখানে সরকারের সচেতনতা, টেক কেয়ার এবং পোল্ট্রি মালিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ জিনিসগুলো বুঝাতে হবে ও দেখাশোনা করতে হবে। পোল্ট্রি খামারগুলোকে আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে উল্লেখ করে কৃষি খাতের মতো ঋণের ব্যবস্থা করা হোক। এবং লম্বা সময় যাতে তারা সাসটেইন করতে পারে সে অনুযায়ী ঋণ দিতে হবে।’
টাঙ্গাইল জেলা প্রানিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এটা প্রস্তাব করেছি যে দামটা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বছরে একবার না করে, দুইমাস পরপর একবার করা হোক। সিকিউরিটি, খাবার খরচ এগুলো এগুলো কিভাবে আরো কমিয়ে খামার লাভবান করতে পারে সে পরামর্শ আমরা তাদের দিচ্ছি সবসময়।’
উৎপাদন খরচ ও দরপতনের বিষয়ে ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা। জানান, উৎপাদনে ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই ফিডে খরচ হয়। তাই এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস উপদেষ্টার।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘ফিডের দাম কমানোটা খুবই জরুরি। এটা আমরা আলোচনা করেছি মন্ত্রণালয়ে। দাম অবশ্যই কমাতে হবে। তা না হলে ক্ষুদ্র খামারিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ যারা বড় কোম্পানি আছে তারা হয়তো কন্ট্রাক্ট খামারিদের দিয়ে কাজ করতে পারবেন কিন্তু ক্ষুদ্র খামারিরা একবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার অবগত আছে এবং এটা নিয়ে অবশ্যই কাজ করবে।’