
গরুর খুরা রোগ (Foot-and-Mouth Disease - FMD) একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ যা গরু এবং অন্যান্য দুই ক্ষুরওয়ালা প্রাণীকে (যেমন - ছাগল, মহিষ, ভেড়া, শূকর) আক্রান্ত করে। বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশ দেখা যায়, বিশেষ করে বর্ষার শেষ থেকে শীতকাল পর্যন্ত (সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি)। এটি খামারিদের জন্য মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
খুরা রোগের কারণ: এই রোগটি ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ ভাইরাস (FMDV) দ্বারা সৃষ্ট। এই ভাইরাসের বিভিন্ন প্রকার (সেরোটাইপ) রয়েছে, যেমন - এ, ও, সি, স্যাট-১, স্যাট-২, স্যাট-৩ এবং এশিয়া-১। বাংলাদেশে সাধারণত ও, এশিয়া-১ এবং এ টাইপের ভাইরাসের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
রোগের বিস্তার: খুরা রোগ অত্যন্ত ছোঁয়াচে। এটি নিম্নলিখিত উপায়ে ছড়াতে পারে:
- আক্রান্ত পশুর লালা, নিঃশ্বাস, দুধ, মল-মূত্র এবং ফোস্কা ফেটে যাওয়া রস থেকে।
- দূষিত খাদ্য, পানি, পোশাক, জুতা এবং খামারের সরঞ্জামাদির মাধ্যমে।
- বাতাসের মাধ্যমেও এই ভাইরাস বেশ দূর পর্যন্ত (৬০-৭০ কিলোমিটার) ছড়াতে পারে।
- আক্রান্ত পশুকে হাট-বাজারে নিলে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
- আক্রান্ত পশুর পরিচর্যাকারীর মাধ্যমেও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
খুরা রোগের প্রধান লক্ষণসমূহ: আক্রান্ত পশুতে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়:
- জ্বর: শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় (১০৪-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে)।
- মুখে ঘা ও লালা: জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, ঠোঁট ও মুখের ভেতরে ফোস্কা পড়ে যা পরে ফেটে গিয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে। এর ফলে মুখ থেকে প্রচুর লালা ঝরে, সাদা ফেনা তৈরি হয় এবং পশু চপচপ শব্দ করে।
- পায়ে ঘা ও খোঁড়ানো: পায়ের ক্ষুরের মাঝে ও উপরের অংশে ফোস্কা পড়ে এবং পরে ঘা হয়। এতে পশু খুঁড়িয়ে হাঁটে এবং দাঁড়াতে বা চলাফেরা করতে কষ্ট পায়।
- খাদ্য গ্রহণে অরুচি: মুখে ঘা থাকার কারণে পশু ঠিকমতো খেতে পারে না, ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে।
- দুধ উৎপাদন কমে যাওয়া: দুধেল গাভীর দুধ উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।
- ওলানে ফোস্কা: কিছু ক্ষেত্রে ওলানেও ফোস্কা দেখা দিতে পারে।
- বাছুরের মৃত্যু: অল্প বয়স্ক বাছুরের ক্ষেত্রে এই রোগ প্রায়শই মারাত্মক হয় এবং মৃত্যুহারও বেশ বেশি (টাইগার হার্ট ডিজিজের কারণে হঠাৎ মারা যেতে পারে)।
- গর্ভপাত: গর্ভবতী গাভীর গর্ভপাত হতে পারে।
খুরা রোগের চিকিৎসা ও করণীয়: খুরা রোগ ভাইরাসজনিত হওয়ায় এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা এবং সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে পশুকে সুস্থ করে তোলা যায় এবং জটিলতা কমানো যায়:
- আক্রান্ত পশুকে আলাদা করা: প্রথমেই আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে পরিষ্কার ও শুকনো জায়গায় রাখতে হবে।
- ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা:
- মুখের ঘা: পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট এর দ্রবণ (১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম) বা ফিটকিরির পানি (১ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম) দিয়ে দিনে ২-৩ বার মুখ ধুইয়ে দিতে হবে। সোহাগার খৈ (ভাজা সোহাগা) মধুর সাথে মিশিয়ে মুখের ঘায়ে প্রলেপ দেওয়া যেতে পারে।
- পায়ের ঘা: পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণ বা অন্য কোনো জীবাণুনাশক দিয়ে পায়ের ঘা পরিষ্কার করতে হবে। খাওয়ার সোডা (১ লিটার পানিতে ৪০ গ্রাম) দিয়েও পায়ের ঘা পরিষ্কার করা যায় এবং এরপর সালফানিলামাইড পাউডার লাগানো যেতে পারে। মাছি তাড়ানোর জন্য ন্যাপথলিন বা তারপিন তেল ব্যবহার করা যেতে পারে।
- নরম ও তরল খাবার: পশুকে নরম ও সহজপাচ্য খাবার দিতে হবে।
- জ্বর ও ব্যথা কমানো: পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জ্বর ও ব্যথা কমানোর ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।
- স্যালাইন: পশু খুব দুর্বল হয়ে গেলে এবং লালা বেশি ঝরলে পশু চিকিৎসকের পরামর্শে স্যালাইন (যেমন - ডেক্সট্রোজ স্যালাইন) দেওয়া যেতে পারে।
- সেকেন্ডারি ইনফেকশন রোধ: ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
- পরিবেশ পরিষ্কার রাখা: গোয়াল ঘর বা যেখানে আক্রান্ত পশু রাখা হয়, সেই জায়গা প্রতিদিন পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। ১-২% কস্টিক সোডা বা ৪% সোডিয়াম কার্বোনেট দ্রবণ দিয়ে গোয়াল ঘর পরিষ্কার করা যেতে পারে।
খুরা রোগ প্রতিরোধ: প্রতিরোধই খুরা রোগ নিয়ন্ত্রণের সর্বোত্তম উপায়। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি:
- টিকা প্রদান: সুস্থ পশুকে নিয়মিত (সাধারণত বছরে দুইবার, বা পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী) খুরা রোগের টিকা দিতে হবে। ৪ মাস বয়স থেকে টিকার কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। স্থানীয় ভাইরাসের ধরনের সাথে মিল রেখে তৈরি করা টিকা বেশি কার্যকর।
- বায়োসিকিউরিটি (জৈব নিরাপত্তা): খামারের জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। খামারে অপ্রয়োজনীয় মানুষের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাইরে থেকে আনা পশু অন্তত ১৫ দিন আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং টিকা দিয়ে তারপর খামারে প্রবেশ করাতে হবে।
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: খামারের ভেতর ও আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- সচেতনতা: রোগাক্রান্ত পশু কেনা-বেচা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো এলাকায় রোগ দেখা দিলে দ্রুত স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিসে জানাতে হবে।
- মৃত পশুর সৎকার: খুরা রোগে মারা যাওয়া পশুকে সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে (৪-৫ ফুট গভীরে), খোলা স্থানে ফেলে রাখা যাবে না।
খুরা রোগের লক্ষণ দেখা দিলে বা কোনো সন্দেহ হলে দ্রুত রেজিস্টার্ড পশু চিকিৎসক অথবা নিকটস্থ উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে যোগাযোগ করা অত্যন্ত জরুরি। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই রোগ থেকে পশুকে রক্ষা করা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানো সম্ভব।