২০০৭ সালে চীনে হাইব্রিড ধানের আবাদ দেখতে হুনান প্রদেশের রাজধানী চাংশা থেকে চিয়াংশিতে গিয়েছিলাম। পাহাড়ঘেরা সেই অঞ্চলটি তখন চীনের অন্যতম বড় হাইব্রিড ধান উৎপাদনের ক্ষেত্র। আজ ফিরে তাকালে মনে হয়, আমি যেন সময়ের এক মোড়ে দাঁড়িয়ে একটি কৃষি বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছিলাম।
বিজ্ঞানীদের তথ্য, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, অর্থাৎ ৩৫০ কোটি (২০০৭ সালে) মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত।
জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদও ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। এই চিন্তায় চীন অগ্রপথিক। বিশাল ভূখণ্ড হলেও পাহাড়ি অঞ্চল আর বিপুল জনসংখ্যার চাপে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে তারা সব সময় ভাবনায় ছিল। সেই ভাবনা থেকে ১৯৭৩ সালে হুনানের রাজধানী চাংশায় বিজ্ঞানী ইয়ান লং পিংয়ের হাত ধরে জন্ম নেয় হাইব্রিড ধান।
চিয়াংশি ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত খাদ্যঘাটতির এলাকা ছিল। এরপর তারা হাইব্রিডের আবাদের এত প্রসার ঘটায়, শিগগিরই তারা খাদ্য উদ্বৃত্তের জেলায় পরিণত হয়েছে।
দুই লাখ ১০ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটারের হুনান প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় প্রিফেকচার চিয়াংশি আদিবাসী অধ্যুষিত একটি জনপদ। তাদের নেতৃত্ব ও প্রভাবে পরিচালিত এই এলাকার প্রশাসনিক কাঠামোকে বলা হয় অটোনোমাস প্রিফেকচার।
প্রিফেকচার হচ্ছে প্রদেশের চেয়ে ছোট, বিভাগের চেয়ে বড় একটি প্রশাসনিক কাঠামো। এর অধীনে রয়েছে আটটি কাউন্টি।
চিয়াংশি সফরে যেন প্রাচীন চীনের সঙ্গে আধুনিক কৃষির মেলবন্ধন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উত্তর হুনানের এই প্রিফেকচারে আছে পাহাড়, নদী আর অক্লান্ত মানুষ। এখানে কৃষক মানেই সংগ্রামী, পরিশ্রমী এবং পরিবর্তনের পথিক।
মাঠে মাঠে তখন ধান মাড়াইয়ের ব্যস্ততা। চৌকোণ বাক্সে ধান মাড়াই করছেন কৃষকরা। এতে ক্ষতি আর অপচয় কম। লং নাম নামের এক কৃষকের সঙ্গে কথা হলো। বললেন, ‘আমার দুই একর জমি। আগে স্থানীয় জাতের ধান চাষ করতাম, ফলন এত কম ছিল যে পরিবারের খাবারও জুটত না। ১৯৮৫ সালের দিকে হাইব্রিড আবাদ শুরু করি। তখন প্রতি হেক্টরে ছয়-সাত টন ফলন পেতাম। এখন তা ৯ টনেরও বেশি।’
লংয়ের কথায় আমি যেন হুনানের রূপান্তর দেখতে পেলাম। চারদিকে পাথুরে পাহাড়, তবু এই মানুষগুলো হাল ছাড়েননি। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট টুকরা জমিতে তাঁরা নতুন আশার বীজ বুনেছেন। হাইব্রিড তাঁদের শুধু ফলন নয়, দিয়েছে মর্যাদা, আত্মবিশ্বাস আর জীবনের নিশ্চয়তা।
১৯৮০ সালের আগে এখানে খাদ্যাভাব ছিল ভয়াবহ। ১৯৭৮ সালে হাইব্রিড ধান কৃষক পর্যায়ে পৌঁছানোর পর থেকে দৃশ্যপট বদলে যায়। রাজধানী চাংশা থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে চিয়াংশিতে এই সুফল পৌঁছতে আরো দু-তিন বছর লেগে যায়। কিন্তু একবার যখন পৌঁছল, তখন থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রতি হেক্টরে সাত থেকে দশ টন ফলন। এই পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের চেষ্টাও। ওয়ান নামের এক কৃষক হাইব্রিড ধানের সফলতা পেয়ে পরে হাইব্রিড মরিচ চাষে ঝুঁকে পড়েন। বলেছিলেন, ‘১৯৯৮ সালে মরিচ চাষ শুরু করি, প্রতি হেক্টরে ফলন সাত টন। এখন শুধু স্থানীয় বাজারে নয়, রপ্তানি করছি থাইল্যান্ড, কোরিয়া, জাপানে। অর্থনৈতিক সাফল্য এসেছে, জীবনে এসেছে আলো।’
কৃষকের পাশে থেকে কাজ করছিল চিয়াংশি অটোনোমাস কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সেখানকার বিজ্ঞানীরা শুধু গবেষণায় সীমাবদ্ধ নন, কৃষকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করেন।
ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, ‘হাইব্রিড ধান আসার আগে চরম খাদ্যঘাটতি ছিল। এখন ৯৯.৫ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড ধানের আবাদ হয়। উদ্বৃত্ত উৎপাদনই এখন আমাদের পরিচয়। কৃষকরা প্রতি হেক্টরে পান ২০০ আরএমবি ভর্তুকি, সঙ্গে গবেষণা ও সম্প্রসারণ সহায়তা।’
ওই ইনস্টিটিউটে দেখেছিলাম বীজ প্রক্রিয়াকরণ শেড। ভুট্টা, মরিচ, বাদামসহ নানা ফসলের মাতৃজাত বীজ সেখানে প্রস্তুত হচ্ছে। কৃষকরা সব সময় যাতে ভালো বীজ পান, তা নিশ্চিত করছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রফেসর লি লাইসাউজিয়ান বললেন, ‘হাইব্রিড বীজ উৎপাদন জটিল, তাই এক জাতের ফলন কমলেই আমরা কৃষককে পরিচয় করাই নতুন জাতের সঙ্গে। এখন এলপি-৭০ নামের জাতটি জনপ্রিয়, হেক্টরপ্রতি ৯ থেকে ১০ টন ফলন। আমরা নতুন জাত নিয়ে কাজ করছি, যার ফলন হবে ১২ টনেরও বেশি।’
আমি ভাবছিলাম, এই নিয়মিত গবেষণা আর কৃষকবান্ধব মনোভাবই তো তাদের শক্তি। কৃষকের চিন্তায় নতুনত্ব আনতে তারা কখনো থামে না। পাশের গ্রামের নাম ফাওফিন। সেখানে এক পাহাড়ের পাদদেশে বৃদ্ধ কৃষক দম্পতি ধান মাড়াই করছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘এবার হেক্টরপ্রতি সাড়ে ৯ টন পেয়েছি। প্রথমে বিশ্বাসই করিনি, এমন ফলন সম্ভব!’ তাঁদের চোখে-মুখে যে আনন্দ দেখেছিলাম, তা আজও ভুলিনি।
হুনানের সেই পাহাড়ি গ্রামের ধানগন্ধে ভেজা বাতাস আজও যেন মনে করিয়ে দেয়, কৃষির উন্নতি মানেই জাতির উন্নতি। সেই উন্নতির শুরু হয় এক বীজ থেকে, এক মানুষের স্বপ্ন থেকে। ইয়ান লং পিং সেই স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন, আর আমার সৌভাগ্য যে তার ফলন দেখেছিলাম নিজের চোখে।























