চলতি বোরো মৌসুমে ১২ একর জমি চাষ করছেন ফরিদ মিয়া। কিশোরগঞ্জের নিকলীর শিংপুর ইউনিয়নের পূর্ব শিংপুরে বাড়ি তাঁর। জমির জন্য সপ্তাহখানেক আগে বিসিআইসির স্থানীয় ডিলারের কাছে যান তিনি। তাঁর পাঁচ বস্তা সার প্রয়োজন হলেও পেয়েছেন মাত্র দুই বস্তা। ডিলাররা তাঁকে জানান, এবার তাদের কাছে বরাদ্দ এসেছে কম।
আসন্ন বোরো ও ভুট্টা চাষের মৌসুমের শুরুতেই সার সংকটে পড়েছেন কিশোরগঞ্জের চাষিরা। বিষয়টি স্বীকার করেছেন কৃষি কর্মকর্তারাও। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, এবার জেলায় চাহিদার অর্ধেক সার বরাদ্দ হয়েছে। ফলে এই মৌসুমে বোরো ও ভুট্টা চাষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নাও হতে পারে।
রোববার নিকলীর শিংপুর ইউনিয়নের গোড়াদিঘা, রশিদপুর, পূর্ব শিংপুরসহ কয়েকটি গ্রামে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে কথা হয় ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন, বাজারে সারের সংকট চলছে। সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেও মাত্র এক বস্তা সার পাওয়া যায়। এটা চলতে থাকলে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ফসলের ফলনও কম হবে।
রশিদপুর গ্রামের হারুন মিয়ার জমি আছে পাঁচ একর, আব্দুস সালামের আছে পাঁচ একর। তারা কেউই চাহিদামতো সার পাচ্ছেন না। একই অভিযোগ গোড়াদিঘা গ্রামের নিস্তার মিয়া ও হারিছ মিয়াসহ অন্যদেরও। তারা জানান, শিংপুর ইউনিয়নে বিসিআইসির সার ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের ভৈরব উপজেলার জসিম উদ্দিনকে। তিনি ২০ বছর দায়িত্ব পালনের পর মারা যান। ১০ বছর ধরে এই দায়িত্বে আছেন তাঁর ছেলে আল আমিন। এখন শিংপুরে চাহিদামতো সারের সরবরাহ নেই। কৃষকদের দাবি, শিংপুর ইউনিয়নে স্থানীয় ডিলার নিয়োগ দিলে এই ভোগান্তি হতো না। তবে আল আমিন জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি শিংপুরে সার পাঠাবেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী নিজ এলাকায় ডিলার না পাওয়া গেলে পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ডিলার নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এক উপজেলার বাসিন্দার অন্য উপজেলায় ডিলারশিপের লাইসেন্স পাওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন একাধিক ডিলার। অথচ নিকলী উপজেলায় ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মাঝের দুই উপজেলা ডিঙিয়ে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের ভৈরব থেকে। এমন ক্ষেত্রে প্রায়ই বরাদ্দ সার কৃষি এলাকার বাইরে চোরাই পথে বাড়তি দামে বিক্রির অভিযোগ ওঠে।
একই অভিযোগ তুলেছেন হাওরের অপর উপজেলা ইটনার চাষিরাও। উপজেলার এলংজুড়ি ইউনিয়নেও বিসিআইসির ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ভৈরবের ব্যবসায়ী মো. জুবায়েদ হাসানকে। ইউনিয়নের মন্তষপাড়ার কৃষক মো. আব্দুল জব্বার এ নিয়ে গত ২৯ জুলাই জেলা প্রশাসক ও জেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান জানিয়েছেন, জেলায় বিসিআইসির ডিলার রয়েছেন ১৭৫ জন। পাশাপাশি ৬৫ জন বিএডিসির ডিলারও আছেন। তাদের ক্ষেত্রে অন্য উপজেলায় লাইসেন্স পাওয়ার অভিযোগ নেই।
জেলা খামারবাড়ি সূত্র জানায়, নভেম্বর মাসের জন্য মন্ত্রণালয়ে ইউরিয়া সারের চাহিদা দেওয়া হয়েছিল ১০ হাজার ১৬৪ টন। বরাদ্দ হয়েছে চার হাজার ৮৭৭ টন। টিএসপির চাহিদা দেওয়া হয় দুই হাজার ৬৭৭ টন, বরাদ্দ হয়েছে দুই হাজার ১৫ টন। ডিএপি সারের চাহিদা দেওয়া হয়েছিল সাত হাজার ৬৫৫ টন। বরাদ্দ হয়েছে চার হাজার ৩৯১ টন। এমওপি সারের চাহিদা দেওয়া হয়েছিল সাত হাজার ৪৩৬ টন। বরাদ্দ হয়েছে তিন হাজার ১২০ টন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও জেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব ড. সাদিকুর রহমানের ভাষ্য, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পুরোদমে হাওর এলাকায় বোরো বীজতলা তৈরির কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া এখন ভুট্টার আবাদ শুরু হয়েছে। বীজতলা ও ভুট্টার জন্য নভেম্বরেই সারের প্রয়োজন হবে। তবে শিগগিরই সারের সংকট কেটে যাবে।
এই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের বোরো বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত হাজার ৮৪৩ দশমিক ১০ হেক্টর। আর বোরো জমি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৮ হাজার ২৬০ হেক্টর। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সাত লাখ ৯৬ হাজার ৬৮৬ টন। অন্যদিকে ভুট্টা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে হাওর অধ্যুষিত উপজেলা নিকলী, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও বাজিতপুরেই লক্ষ্যমাত্রা ৯ হাজার ৩৭৫ হেক্টর জমি। জেলায় এবার ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ২০ হাজার ৫০৯ টন।
জেলায় বিসিআইসির ডিলারদের মধ্যে নিজ উপজেলার বাইরে অন্তত ৩০ জন ডিলারশিপ পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন ড. সাদিকুর রহমান। তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০২৫’ প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সেটি চূড়ান্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নীতিমালা চূড়ান্ত হলে নিজ ইউনিয়নের বাইরে ডিলার নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।























