দেশে মোট আবাদি জমির প্রায় ৭২ থেকে ৭৮ শতাংশজুড়ে ধানের চাষ হয়। ফলে অন্যান্য খাদ্যশস্য, শাক-সবজি, ডাল ও তেলবীজ উৎপাদন ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি এখন পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য ধাননির্ভর কৃষি থেকে ধীরে ধীরে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মোট ধান আবাদি জমির অন্তত ১০ শতাংশ বিকল্প ফসলের আওতায় আনলে পুষ্টি ঘাটতি অনেকটা পূরণ হবে এবং কৃষকের আয়ও বাড়বে। তবে এর আগে ধান উৎপাদন বৃদ্ধির দিকেও নজর দিতে হবে।
তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ফসলি জমি এক কোটি ৬০ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ধানের আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ হেক্টর।
বছরে একবার আবাদ হয় এমন জমির পরিমাণ ২১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর, দুই ফসলি জমি ৪১ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর, তিন ফসলি জমি ১৮ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর এবং চার ফসলি জমি ২৩ হাজার হেক্টর। ধানের আবাদি জমির প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ হেক্টরের বিপরীতে সবজির আবাদি জমি ১২ লাখ হেক্টরেরও কম। প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টরে হয় আলুর আবাদ। ডালের আবাদ সাত লাখ হেক্টরে এবং তেলফসলের আবাদ হয় প্রায় ১১ লাখ হেক্টরে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুধু ধান ও গমকে ‘খাদ্য নিরাপত্তার প্রতীক’ হিসেবে ধরে রেখেছি। কিন্তু বাস্তবে খাদ্য নিরাপত্তা মানে শুধু পেট ভরানো নয়, বরং সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করাও এর অংশ। একচেটিয়া ধান চাষের ফলে মানুষ পর্যাপ্ত কার্বোহাইড্রেট পেলেও প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। তাঁরা বলেন, ধানের আবাদি জমির মাত্র ১০ শতাংশও যদি বিকল্প ফসলের জন্য ব্যবহার করা যায়, তাহলে দেশের পুষ্টি ঘাটতির চিত্র অনেকটা বদলে যাবে। এর সঙ্গে কৃষকের ঝুঁকিও কমবে, কারণ একাধিক ফসল থাকলে দাম ও আবহাওয়াজনিত ক্ষতির প্রভাব কমে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস হিসাব কষে দেখিয়েছেন, অন্তত ৫ থেকে ১০ শতাংশ জমি ফিরিয়ে দিলে মোট ধান উৎপাদনের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, বর্তমানে বোরো ও আমন চাষের আওতায় জমি আছে যথাক্রমে পাঁচ মিলিয়ন হেক্টর ও ৫.৭৫ মিলিয়ন হেক্টর। বোরো, আউশ ও আমন—এই তিন মৌসুম মিলিয়ে মোট ধানি জমির পরিমাণ ১১.৮৪ মিলিয়ন হেক্টর, যা প্রকৃত আবাদযোগ্য জমির চেয়ে দেড় গুণ বেশি। কারণ একই জমিতে একাধিকবার ধানের চাষ করা হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের প্রচলিত উফশী বোরো, আউশ ও আমন ধানের ফলন হেক্টরপ্রতি যথাক্রমে পাঁচ টন, ৪.৫ টন এবং ৩.৫ টন পাওয়া কোনো সমস্যা নয়। মৌসুমভেদে এই ফলনের মাত্রা বজায় রাখতে পারলে ১০ শতাংশ জমি অন্য ফসলের জন্য ছাড় দিয়েও আমাদের সাম্প্রতিক চাহিদা ৪২ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করা সম্ভব।’ তাঁর মতে, যথাযথ কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা গেলে শুধু ১০ শতাংশ নয়, ১৫ শতাংশ ধানের জমিও ছাড় দেওয়া সম্ভব। এতে গম, পাট, ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বাড়ানো যাবে। ধান থেকে ছাড়কৃত জমিতে বৃষ্টিনির্ভর বা অল্প সেচনির্ভর ফসল ফলিয়ে শুধু উৎপাদন ব্যবস্থায় নয়; খাদ্য নিরাপত্তায়ও একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, ধানের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা শুধু ফসলের বৈচিত্র্যই কমায়নি, মাটির উর্বরতা ও পানিসম্পদেও চাপ ফেলেছে। ধান চাষে যে পরিমাণ পানি ও সার লাগে, তা অন্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। তাঁরা বলেন, ধান চাষের সঙ্গে ডাল, তেলবীজ, শাক-সবজি বা ভুট্টা যুক্ত করলে শুধু পুষ্টিই নয়, মাটির স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। যেমন, মুগডাল বা খেসারির চাষ মাটিতে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে, যা পরবর্তী মৌসুমে ধানের ফলন বাড়ায়। একই ফসলের বারবার আবাদে মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং রোগ-পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পায় বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সয়েল সার্ভে অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মামুনুর রহমান, একই জমি প্রতিবছর একই ধরনের শস্য আবাদ করলে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। তাই ফসল আবাদের ক্ষেত্রে শস্য বিন্যাস জরুরি। তিনি মনে করেন, কৃষকরা সাধারণত আশপাশের পরিবেশ ও আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় জমি আবাদ করে থাকেন।
তবে পুষ্টিবিদরা মনে করেন, শুধু কৃষিক্ষেত্রে ফসল বৈচিত্র্য বাড়ালেই হবে না; খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও সচেতনতাও জরুরি। বাংলাদেশে এখনো গড়ে একজন মানুষ দৈনিক যা খায়, তার প্রায় ৭০ শতাংশই ভাত। ফলে শরীরে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট জমে এবং প্রোটিন-ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন মনে করেন, বিষয়টি নিয়ে গবেষণা জরুরি। তিনি বলেন, একজন মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে শুধু ভাত যথেষ্ট নয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ শাক-সবজি, মাছ-মাংস প্রয়োজন। কিন্তু ধানের আবাদ শেষে খুব কম পরিমাণ জমিই থাকে শাক-সবজি আবাদে। শাক-সবজি আবাদে জমির পরিমাণ আরো বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাসুদুল হক ঝন্টু মনে করেন, ধান আবাদের জমি থেকে কিছু অংশ সরিয়ে অন্যান্য ফসলে নিয়ে আসা উচিত। এতে মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
মিরপুরের বাসিন্দা হান্নান তালুকদার বলেন, তাঁর দুই সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবারে মাসে এক হাজার টাকার চাল লাগে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের সবজি, মাছ-মাংস কিনতেই চলে যায় ২০ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু সবজি কিনতেই খরচ হয় প্রায় আট হাজার টাকা। তাই সবজি উৎপাদনে বাড়তি নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ধানের জমি অন্য ফসলে রূপান্তর করা প্রয়োজন। তবে এর আগে ধানের উৎপাদন অন্তত ২০ শতাংশ বাড়াতে হবে। এ জন্য উচ্চ ফলনশীল জাত, উন্নত হাইব্রিড উদ্ভাবন এবং অনাবাদি জমিকে আবাদযোগ্য করে তুলতে হবে। তাঁর মতে, কৃষক পুষ্টি নিরাপত্তার চেয়ে ধান উৎপাদনের মাধ্যমেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান। এ কারণে চাইলেই তাঁদের ধান থেকে সরিয়ে সবজিতে নেওয়া যাবে না।
তথ্য দিয়ে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের মানুষের বছরে ১৫২ কেজি চাল খেলেই হয়, কিন্তু বাস্তবে খায় ১৮০ কেজি। ১৮০ কেজি হিসাবে বছরে চাল প্রয়োজন প্রায় তিন কোটি টন। এর সঙ্গে মাছ-মুরগির খাবার, অপচয় ও বীজের জন্য ধান রাখতে হয়। সব মিলিয়ে আমাদের চাল উৎপাদন চার কোটি টনের বেশি হলেও বছরে প্রায় ৩৫ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়। এই গবেষক মনে করেন, বাংলাদেশে পুষ্টি নিরাপত্তা এখন সময়ের দাবি। এ জন্য ব্যক্তিপ্রতি দৈনিক ৩০০ গ্রাম সবজি খাওয়া দরকার, কিন্তু আমরা খেতে পারছি মাত্র ২০০ গ্রাম। অনাবাদি জমি খুঁজে বের করে সেখানেও সবজির আবাদ করতে হবে। এভাবে প্রায় চার লাখ হেক্টরে বাড়তি উৎপাদন সম্ভব। তিনি আরো বলেন, সবজি, মাছ ও মাংসের উৎপাদন বাড়ছে। তবে সরকার থেকে যেভাবে তা দেখানো হয়, বাস্তব চিত্র ঠিক তেমন নয়। সূত্র: কালের কণ্ঠ























