দক্ষিণের খালবেষ্টিত গ্রামগুলোতে এখন টক স্বাদের সঙ্গে মিশেছে টাকার গন্ধ। ঝালকাঠি, বরিশাল আর পিরোজপুরের ভাসমান বাজারে সারি সারি নৌকাভর্তি সবুজ আমড়া; সেখান থেকেই পাড়ি দিচ্ছে ঢাকার মোড় থেকে দেশের বড় শহরগুলোতে। একসময় গৃহস্থের আঙিনার ফল আজ হয়ে উঠেছে কৃষকের আয়ের প্রধান ভরসা। বছরে শতকোটি টাকার এই বাণিজ্যে বদলে যাচ্ছে দক্ষিণের গ্রামীণ অর্থনীতি। তৈরি হচ্ছে ‘সবুজ টাকার’ এক নতুন গল্প।
ঢাকার ট্রাফিক সিগনালের লাল আলোয় থেমে থাকা গাড়ির জানালায় টোকা পড়ে, ‘স্যার, আমড়া লাগবে?’ স্বচ্ছ পলিথিনে কাটা আমড়া, সঙ্গে নুন-মরিচ আর একচিলতে হাসি। কখনো বা ফালি ফালি করে কেটে তা কাঠির মাথায় শাপলা ফুলের আদলে সাজানো। এই দৃশ্য এখন রাজধানীর প্রতিদিনের চেনা ছবি।
তবে ঢাকা শহরের এই কাঁচা-টক ব্যবসার শিকড় ছড়িয়ে আছে দক্ষিণের খালবেষ্টিত গ্রামে। ভীমরুলি, আটঘড়-কুড়িয়ানা, জিন্দকাঠির মতো ভাসমান বাজারে এখন ভাসছে হাজার নৌকা। সেই নৌকায় ভর্তি সবুজ আমড়া। মৌসুমজুড়ে চলছে দরদামের সুরে নদীবাজার, গড়ে উঠছে দক্ষিণের গ্রামীণ অর্থনীতির এক নতুন অধ্যায়।
এ বছর প্রায় ২৪ হাজার টন আমড়া উৎপাদন হয়েছে, যার বাজারমূল্য ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
কৃষকের মুখে ‘সবুজ স্বপ্ন’ : একসময় গৃহস্থবাড়ির কোণে ঝুলত আমড়ার টলমলে ফল। এখন তা দক্ষিণাঞ্চলের আয়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ঝালকাঠি সদর উপজেলার কৃষক ওয়াহিদুল ইসলাম হিরু জানান, ‘প্রায় ৩০ বছর আগে পেয়ারাবাগানের পাশে কয়েকটি আমড়াগাছ লাগাইছিলাম। এখন ২০ একর জমিতে বছরে ৮০ থেকে ১০০ টন ফল পাই।
বিক্রি করি ৩০ লাখ টাকারও বেশি। মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণ (স্থানীয়ভাবে ৪৪ কেজি) আমড়ার দাম ছিল ৮০০-৯০০ টাকা, পরে তা বেড়ে দুই হাজার টাকায় পৌঁছেছে।
স্বরূপকাঠীর জিন্দকাঠি গ্রামের কৃষক শুভাস মণ্ডল বলেন, আগে পেয়ারা থেকে বছরে তিন একর জমিতে খরচ বাদ দিয়ে দেড় লাখ টাকার মতো পেতাম। এখন সেই একই জমিতে পেয়ারার পরিবর্তে আমড়া চাষ করে লাভ পাচ্ছি তিন লাখের কাছাকাছি। এর জন্য অর্ধেকের বেশি পেয়ারাগাছ তুলে ফেলে সেখানেই আমড়া রোপণ করেছি। অন্য কৃষক দীপক মৈত্র জানান, এক বিঘা জমি থেকে ৫০ মণ আমড়া তুলেছি, বিক্রি করেছি ৭৫ হাজার টাকায়। একই জমিতে পেয়ারা দিলে ১৭ হাজার টাকার বেশি পেতাম না। তিন বছরের মধ্যে গাছ পরিপক্ব হয়। এর পর থেকে শুরু হয় প্রকৃত লাভের মৌসুম।
সরকারি পরিসংখ্যান ও সম্ভাবনা : স্থানীয় পাইকার তাপস ব্যাপারী জানান, প্রতিদিন দক্ষিণের তিন উপজেলা থেকে ৫০-৬০ জন বড় ব্যবসায়ী ২০০-৩০০ মণ আমড়া পাঠান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। তবে কৃষকদের অভিযোগ, বড় লাভের অংশ তাদের হাতে পৌঁছায় না। ঝালকাঠির কৃষক নিত্যানন্দ সমাদ্দার বলেন, ‘ঢাকার পাইকাররাই দাম ঠিক করেন। আমরা শুধু নৌকায় বোঝাই করে পাঠাই। আমাদের এলাকায় কোনো ফ্যাক্টরি বা কোল্ড স্টোরেজ নেই, তাই বাধ্য হয়ে কম দামে ঢাকায় পাঠাতে হয়।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত আমড়া ৪৫ হাজার ৪০০ টন। বরিশাল বিভাগেই উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ। এ বছর বরিশালেই এক হাজার ৮৪৯ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার টন আমড়া, যার বাজারমূল্য ছাড়িয়েছে ১০০ কোটি টাকা।
পিরোজপুরে তিন হাজার ৩৯০ কৃষক ৫৭৭ হেক্টর জমিতে আমড়া চাষ করে ১০ হাজার টনের বেশি ফল তুলেছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রথম বছরে খরচ কিছুটা বেশি, তবে পরের বছর থেকে তা এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে। পেয়ারার চেয়ে আমড়া কম পচনশীল, তাই অনেক কৃষক এখন এদিকে ঝুঁকছেন।
ঝালকাঠিতে ৬০২ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয়েছে চার হাজার ৫৭৮ টন আমড়া। সেখানকার কৃষি বিভাগের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, প্রতি একর জমিতে আমড়া চাষে খরচ ৭৫-৮০ হাজার টাকা, কিন্তু আয় পৌনে দুই লাখ পর্যন্ত হয়। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাজারমূল্য আরো বেড়েছে।























