ঢাকা   শনিবার
০৫ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২, ০৯ মুহররম ১৪৪৭

দেশের শস্য ভান্ডারে যুক্ত হলো নতুন ছয় জাতের ধান

মোহাম্মদ আব্দুল মোমিন

প্রকাশিত: ১২:০১, ৫ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১২:০৭, ৫ জুলাই ২০২৫

দেশের শস্য ভান্ডারে যুক্ত হলো নতুন ছয় জাতের ধান

দেশের শস্য ভান্ডারে যুক্ত হলো আরও ছয়টি নতুন ধানের জাত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভাবিত এই ৬টি জাতের পাঁচটিই বৈরী পরিবেশ সহনশীল। নতুন এই ৫টি জাতসহ এখন ব্রির ৩৭টি জাত রয়েছে। সেগুলো বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন বৈরী পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।

বিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। ১৯৭১ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২০ শতাংশ। এখন তা নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। এ সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণ, কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৪ গুণ। স্বাধীনতার পর প্রথম ব্রি উদ্ভাবিত জাত বিআর-৩ বা বিপ্লব জাতের মাধ্যমে ধান উৎপাদনে সত্যিকারের সবুজ বিপ্লব সাধিত হয়। ১৯৯৪ সালে ব্রি জাত-২৮ ও ২৯ জাতের ধান উদ্ভাবন করে। প্রচুর ফলনের কারণে এই দুই জাতের ধান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানে ব্রি উদ্ভাবিত জাত-৮৭, ৮৯, ৯২, ৯৬, ৯৮, ১০০, ১০২, ১০৫, ১০৭ এবং ১০৮ জাতগুলো মৌসুমভেদে মাঠে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। তবুও জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীদের অবিরাম ছুটে চলা থেমে নেই।

এবার ব্রি ধান-১০৯ জোয়ার-ভাটা সহনশীল, ধান-১১০ বন্যা বা জলমগ্নতা সহনশীল, জলি আমনের জাত-১১১ অগভীর বন্যার পানিতে (১ মিটার) টিকে থাকতে পারে। জাত-১১২ লবণাক্ততা সহনশীল, ২৯-এর বিকল্প উফশী বোরো ধানের জাত-১১৩ এবং ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত-১১৪। এর মধ্যে প্রথম তিনটি জাত গত ১১ মার্চ জাতীয় বীজ বোর্ডের ১১৩তম সভায় অনুমোদন পায়। পরের তিনটি জাত অনুমোদন দেওয়া হয় এনএসবির ১১৪তম সভায়। ১৯৭০ সালে ব্রি প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ১২১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ৮টি হাইব্রিড ধানের জাত।

জোয়ার-ভাটা সহনশীল ব্রি ধান-১০৯
২০০৮ সালে ব্রি ধান-৪৪-এর সঙ্গে ব্রি ধান-৫২ সংকরায়ণ করে মার্কার এসিস্টেড ব্যাক ক্রসের মাধ্যমে ব্রি ধান-১০৯ উদ্ভাবিত হয়। এই জাতটি ব্রি’র গবেষণা মাঠে ফলন পরীক্ষার পর ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে দেশের বিভিন্ন বন্যা এবং জোয়ার-ভাটা প্রবণ অঞ্চলে কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ২০২৩ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি ফলন পরীক্ষা করে কৃষকের মাঠে সন্তোষজনক ফলাফল পান। ফলে জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মূল্যায়ন দলের সুপারিশে আমন মৌসুমে দীর্ঘ জীবনকাল সম্পন্ন জোয়ার-ভাটা সহনশীল জাত হিসেবে ব্রি ধান-১০৯ নামে ছাড়া হয়।

ব্রি ধান-১০৯ জাতের ডিগ পাতা খাড়া, গাঢ় সবুজ, প্রশস্ত ও লম্বা, পাতার রং সবুজ। পূর্ণবয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১২৮ সেন্টিমিটার। জাতটির গড় জীবনকাল জোয়ার-ভাটা পরিবেশে ১৪৭ দিন। চালের আকার লম্বা ও মাঝারি মোটা, রং সাদা। এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ৩১ গ্রাম। এ ধানের দানায় অ্যামাইলেজের পরিমাণ শতকরা ২৫.৪ ভাগ। এ ছাড়া প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ১০.৬ ভাগ এবং ভাত ঝরঝরে। ফলন পরীক্ষায় জোয়ার-ভাটা মুক্ত এলাকায় জাতটি প্রতি হেক্টরে ৬.৩২ টন এবং জোয়ারভাটা প্রবণ এলাকায় প্রতি হেক্টরে ৫.৪০ টন গড় ফলন দিয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশে সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে এ জাতটি হেক্টর প্রতি ৬.৫০ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।

বন্যা সহনশীল ব্রি ধান-১১০
ব্রি ধান-১১০ জাতের ডিগ পাতা খাড়া, গাঢ় সবুজ, প্রশস্ত ও লম্বা। পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১২০ সেন্টিমিটার। জাতটির গড় জীবনকাল বন্যামুক্ত পরিবেশে ১২৩ দিন। দুই সপ্তাহের বন্যায় ১৩৩ দিন। এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ১৯.৯ গ্রাম। চালের আকার লম্বা ও মাঝারি চিকন, রং সাদা। এ ধানের দানায় অ্যামাইলেজের পরিমাণ শতকরা ২৪ ভাগ। এ ছাড়া প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৮.৮ ভাগ এবং ভাত ঝরঝরে। এ জাতের ধানের দানার অগ্রভাগে এবং গাছের গোড়ার দিকের লিফশিথে কালচে গোলাপি বর্ণ দেখা যায়।

এটি দেশের আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকার উপযোগী এবং স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন জাত। এর গড় জীবনকাল ১২৩ দিন। বন্যামুক্ত এলাকার জন্যও জাতটি চাষাবাদযোগ্য। ফলন পরীক্ষায় বন্যামুক্ত এলাকায় প্রতি হেক্টরে গড়ে ৬ টন এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় প্রতি হেক্টরে গড়ে ৫ টন গড় ফলন দিয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশে সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে এ জাত হেক্টরে ৬.৬৫ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।

জলি আমনের জাত ব্রি ধান-১১১
ব্রি ধান-১১১-এর কৌলিক সারিটির গবেষণা কার্যক্রম ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয়। মাঠ পর্যায়ে উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা ও অগভীর বন্যার পানিতে (১ মিটার) পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়। এটি লম্বা ও হেলে পড়া সহিষ্ণু ধান। গাছের উচ্চতা ১৬২ সেন্টিমিটার। ডিগ পাতা খাড়া ও গাঢ় সবুজ। এ জাতের কাণ্ডের গোড়া বাঁশের মতো শক্ত। কান্ডে শর্করার পরিমাণ প্রচলিত জাতের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। এ জাতের কাণ্ড বহু-বর্ষজীবি। ধান পেকে যাওয়ার পরও কাণ্ড সবুজ ও জীবিত থাকে। তাই কাটিং বা মুড়ি ফসল করে গাছের বংশ বৃদ্ধি করা যায়।  মুড়ি ফসলের ফলনও প্রায় মূল ফসলের মতো।

ব্রি ধান-১১১-এর চাল মাঝারি মোটা ও লম্বা, ভাত সাদা এবং ঝরঝরে। এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৭.৫ গ্রাম। এই জাতটি আলোক-সংবেদনশীল, জীবনকাল ১৪৬-১৬০ দিন। উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা ও  অগভীর পানিতে ৯১ দিন। স্থানীয় আমনের জাতের চেয়ে বেশি ফলন দেয়। ধান কাটার উপযুক্ত সময় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহ। আমন মৌসুমে ব্রি ধান-১১১ পাকা পর্যন্ত ১৪৬-১৬০ দিন সময় লাগে। ব্রি ধান-১১১ রোপা আমন মৌসুমে উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা ও অগভীর পানিতে নিমজ্জিত থেকে হেক্টর প্রতি ৪.৩-৪.৭ টন ফলন দিতে পারে। উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা ও বন্যার মাত্রা কম হলে উপযুক্ত পরিচর্যায় হেক্টর প্রতি  ৫.২- ৫.৭ টন ফলন দিতে সক্ষম।

লবণাক্ততা সহনশীল জাত ব্রি ধান-১১২
ব্রি ধান-১১২ লবণাক্ততা সহনশীল ও মাঝারি জীবনকালের রোপা আমনের জাত। এ জাতের ডিগ পাতা খাড়া। ব্রি ধান-১১২ লবণাক্ততার মাত্রাভেদে হেক্টর প্রতি ৪.১৪-৬.১২ টন ফলন দিতে পারে। এর মাতৃসারি ব্রি ধান-৭৩ থেকে এটি হেক্টরে ১-১.৫ টন বেশি ফলন দেয়। এ জাতের জীবনকাল ১২০-১২৫ দিন। গাছের উচ্চতা ১০৩-১০৫ সেন্টিমিটার। গাছের কাণ্ড মজবুত এবং ঢলে পড়া প্রতিরোধী। এ ধানের শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা গড়ে ২১০টি। মানে ব্রি ধান-৭৩ থেকে ৮০-৯০টি বেশি। এই প্রস্তাবিত জাতটিতে Gn1a জিনের উপস্থিতির কারণে শীষে দানার সংখ্যা বাড়ে। চাল মাঝারি চিকন, সাদা এবং ভাত ঝরঝরে। ব্রি ধান-১১২-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য চারা অবস্থায় ১২ ডিএস/মি. (৩ সপ্তাহ পর্যন্ত) লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। এ জাতটির অঙ্গজ বৃদ্ধি থেকে প্রজনন পর্যায় পর্যন্ত লবণাক্ততা সংবেদনশীল সব ধাপে ৮ ডিএস/মি. মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করে ফলন দিতে পারে। এ জাতটির দানা মাঝারি চিকন এবং শীষ থেকে ধান সহজে ঝরে পড়ে না। জাতটির জীবনকাল তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে ফসল কাটার পর মধ্যম উঁচু থেকে উঁচু জমিতে সূর্যমূখী ও লবণ সহনশীল সরিষা আবাদের সুযোগ তৈরি হয়।

উফশী বোরো ব্রি ধান-১১৩
ব্রি ধান-১১৩ বোরো মৌসুমে জাত-২৯-এর বিকল্প হিসেবে ছাড়া হয়েছে। এটি মাঝারি চিকন দানার উচ্চ ফলনশীল জাত। এ জাতের ডিগ পাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা। ধান পাকলেও সবুজ থকে। পূর্ণবয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০২-১০৫ সেন্টিমিটার। এ জাতের গাছ শক্ত এবং মজবুত বিধায় সহজে হেলে পড়ে না। জাতটির গড় জীবনকাল ১৪৩ দিন। এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ১৯.৪ গ্রাম। চালের আকার আকৃতি মাঝারি চিকন, রং সাদা। দেখতে অনেকটা নাইজারশাইলের মতো। এ ধানের চালে অ্যামাইলেজের পরিমাণ শতকরা ২৮ ভাগ। ভাত ঝরঝরে। এ ছাড়া প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৮.৪ ভাগ। প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষায় এ জাতটি ব্রি ধান-৮৮-এর চেয়ে ১১.৫ শতাংশ বেশি ফলন দিয়েছে। এ জাতের গড় ফলন হেক্টরে ৮.১৫ টন। উপযুক্ত পরিবেশে এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা পেলে জাতটি হেক্টরে ১০.১ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।

ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত ব্রি ধান-১১৪
ব্রি ধান-১১৪ বোরো মৌসুমে দীর্ঘ জীবনকালীন ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত। এ জাতের ডিগ পাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা। গাছ মজবুত এবং হেলে পড়ে না। পাতার রং গাঢ় সবুজ। এর গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৭.৭৬ টন। তবে উপযুক্ত পরিচর্যায় এ ধানের ফলন হেক্টরে ১০.২৩ টন পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ জাতের দানা মাঝারি মোটা এবং সোনালি। গড় জীবনকাল ১৪৯ দিন। বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান-৮৯-এর সমান জীবনকাল। এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ১৭.৪ গ্রাম। চালে অ্যামাইলেজের পরমিাণ শতকরা ২৭ ভাগ। প্রোটিনের পরমিাণ শতকরা ৭.৭ শতাংশ। ভাত ঝরঝরে। জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী। এ জাতটিতে ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী প্রকট জিন pi9 রয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইনোকুলেশনে উচ্চ মাত্রার রোগ প্রতিরোধী (স্কোর-০) ক্ষমতা রয়েছে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)
 

সর্বশেষ