
একের পর এক বন্ধ হচ্ছে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামার। ২০০৯ সালে যেখানে ১ লাখ ৮০ হাজার খামার ছিল সারা দেশে, সেখানে বর্তমানে ৫০ হাজারের কম। গত ছয় মাসেই বন্ধ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার প্রান্তিক খামার।
একের পর এক বন্ধ হচ্ছে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামার। ২০০৯ সালে যেখানে ১ লাখ ৮০ হাজার খামার ছিল সারা দেশে, সেখানে বর্তমানে ৫০ হাজারের কম। গত ছয় মাসেই বন্ধ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার প্রান্তিক খামার। খামারিরা বলছেন, করপোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের সঙ্গে টিকতে না পেরে তাদের দিনের পর দিন লোকসান গুনতে হচ্ছে। এক পর্যায়ে খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খামারিরা কম দামে বাজারে মুরগি বিক্রি করে দিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। ফলে দু-এক মাস পর বাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে। তখন দাম নাগালের বাইরে চলে যাবে।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন ডিমের গড় চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার কোটি পিস। মুরগির মাংসের চাহিদা ৫ হাজার ২০০ টন। এর মধ্যে ব্রয়লার থেকে ৩ হাজার ২০০ এবং সোনালি ও লেয়ার থেকে প্রায় ১ হাজার ৭০০ টন সরবরাহ হয়। দেশে ডিম উৎপাদন হয় প্রায় চার কোটি পিস। এ চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করছেন প্রান্তিক খামারিরা। কিন্তু অব্যাহত লোকসান ও করপোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিদিনই বন্ধ হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের বিভিন্ন ডিম-মুরগির খামার, যা নিকট ভবিষ্যতে সরবরাহ সংকট তৈরি করবে। এতে ডিম-মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ‘রমজান ও ঈদ মৌসুমেও ভয়াবহ লোকসান দিয়ে প্রান্তিক খামারিরা প্রতিদিন ২০ লাখ কেজি মুরগি উৎপাদন করেছেন। এখনো প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগিতে লোকসান দিতে হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা। এছাড়া দৈনিক ৪ কোটি ডিমের মধ্যে প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদন করেন ৩ কোটি। প্রতি ডিমে ২ টাকা করে লোকসান হচ্ছে। এভাবে খামারগুলো আর চলতে পারছে না। ফলে একটা সময় বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। গত ছয় মাসে আমাদের হিসাবে সারা দেশে ৮-১০ হাজার প্রান্তিক খামার বন্ধ হয়েছে।’
করপোরেট কোম্পানিগুলোর কন্ট্রাক্ট ফার্মিংকে এ খাতে অস্থিরতার জন্য দায়ী করছেন বিপিএ সভাপতি। তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেটের কারণে যেসব ক্ষুদ্র খামারি লোকসানে আছেন, তাদের অনেককেই কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে যুক্ত করা হচ্ছে। বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের পরিকল্পিতভাবে ক্ষতির মধ্যে ফেলে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে করে ওই কোম্পানি খামারিকে ফিড, ওষুধ, বাচ্চাসহ যাবতীয় সহায়তা দেবে। ডিম-মুরগির দাম তারাই নির্ধারণ ও বাজারজাত করবে। এতে কিন্তু বাজার প্রতিযোগিতা নষ্ট হবে।’
খামারি টিআইএম জাহিদুর রহিম জোয়ারদার বলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে ডিম উৎপাদন করছি। ব্যাংক ঋণ, খাদ্য, ওষুধ এসবের বিল দিতে দিতে আমরা ঋণী হয়ে যাই। যখন দাম কমে যায় তখন খাবার ও ওষুধের দামই উঠে আসে না। যখন একটু ভালো দাম পাই তখনকার লাভের অংশ দিয়ে ব্যাংকের ঋণ ও অন্যান্য খরচ টানতে না টানতে আবারো দামের পতন হয়ে যায়। এভাবেই খামারিরা চলছে। বিদ্যুতের দাম, খাবার-ওষুধের দাম বেড়েছে। ব্যাংকের সুদও বেড়েছে। সব মিলিয়ে খামারিরা ভালো নেই।’
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার ক্ষুদ্র খামারি বিলকিস আহমেদ বলেন, ‘আমরা বেশির ভাগ সময়ই ঘাটতির মধ্যে আছি। দুই হাজার মুরগির জন্য শ্রমিক খরচ বাদ দিয়েই মাসে ১ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু বিক্রির সময় আমরা দাম পাই না। ছোট খামারিদের কান্না কেউ দেখে না। সরকার যেন এ শিল্পে নজর দেয় এবং ক্ষুদ্র খামারিদের ভর্তুকির মাধ্যমে হলেও টিকিয়ে রাখে।’
সংশ্লিষ্টদের বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড ও ওষুধের দাম কমলেও দেশে কমছে না। ফলে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সরকারের উচিত কীভাবে প্রান্তিক খামারিকে ন্যায্যমূল্যে ফিড, বাচ্চা ও ওষুধ দেয়া যায় সেই পথ বের করা। একই সঙ্গে বাজারে কীভাবে ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা যায়, বাজার প্রতিযোগিতা ঠিক রাখা যায় সেই পথ খোঁজা। অন্যথায় পুরো বাজার ব্যবস্থা করপোরেটদের হাতে চলে যাবে, তখন নিয়ন্ত্রণ বলতে কিছুই থাকবে না। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরাও এ পেশায় টিকে থাকতে পারবেন না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, ‘ডিম-মাংসের ক্ষেত্রে আমরা চিন্তা করি ভোক্তার কথা, উৎপাদকের কথা ভাবি না। যেখানে একটি ডিম উৎপাদন খরচ ১০ টাকা সেখানে বিক্রি করতে হচ্ছে প্রায় ৮ টাকার মতো। এভাবে বাজার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা যায় না। প্রান্তিক খামারিরা এতে ধ্বংস হয়ে যাবে। কয়েক বছর পর দেখা যাবে প্রান্তিক পর্যায়ে কেউ এ পেশায় আসতে চাইবেন না। নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টির একটি বড় উৎস ডিম ও ব্রয়লার মুরগি। এ জায়গা তাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলে বড় সংকট দেখা দেবে। অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগে সরকারকে এ খাতের দিকে নজর দিতে হবে।’ সূত্র: বণিক বার্তা