ঢাকা   শনিবার
২৫ অক্টোবর ২০২৫
৯ কার্তিক ১৪৩২, ০২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

বন্যায় জমা পলিতে নাব্য সংকট, অস্তিত্ব বিনাশের পথে জলাশয়গুলোর 

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

বন্যায় জমা পলিতে নাব্য সংকট, অস্তিত্ব বিনাশের পথে জলাশয়গুলোর 

হাওর, খাল-বিল আর নদনদীসমৃদ্ধ মৌলভীবাজার জেলার জলাশয়গুলোর অস্তিত্ব বিনাশের পথে। পলি ভরাটের কারণে নাব্য সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এ অঞ্চলে। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়াসহ তিন উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত মনু নদ এ জেলার প্রধান জলাধার। উজানের ভারত থেকে বয়ে আসা মনু নদ কুলাউড়ার শরীফপুর থেকে শুরু হয়ে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মৌলভীবাজারের মনুমুখ এলাকায় কুশিয়ারা নদীতে গিয়ে মিশেছে।

২০২২ ও ২০২৪ সালে পরপর দুই দফা ভয়াবহ বন্যায় এ অঞ্চলের মনু নদ ও বিভিন্ন জলাশয়ের অবস্থা ভালোভাবেই নজরে আসে। দীর্ঘদিন থেকে খনন না হওয়ায় নাব্য হারাচ্ছে মনু নদ।

বন্যায় জমা ভারী পলির স্তরে এ অঞ্চলের নদনদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, যা আঞ্চলিক পরিবেশ, প্রকৃতির সঙ্গে স্থানীয় কৃষি ও সমাজজীবনকে প্রভাবিত করছে। সাম্প্রতিক বন্যাগুলোর সময় ভারতের উজান থেকে পানির সঙ্গে নেমে আসা পলি মাটিতে মনু নদ ভরাট হয়ে গেছে অনেকাংশেই। কমে যাচ্ছে গভীরতা, বিভিন্ন স্থানে জেগেছে চর। এমন পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে। নদীর নাব্য সংকটের কারণে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানিপ্রবাহের কারণে বাঁধে ভাঙনসহ বন্যার সৃষ্টি হয়।

সরেজমিন নদ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মনু নদের পৃথিমপাশা, হাজীপুর ও শরীফপুর ইউনিয়নের ধলিয়া, সুখনাভী, রাজাপুর, কটারকোনা, ইসমাইলপুর, রনচাপ, নিশ্চিন্তপুরসহ বিভিন্ন স্থানে জেগেছে বিশাল চর। এসব চরের কারণে গত বর্ষায় বেড়িবাঁধের শিকরিয়া এলাকায় প্রায় ৩০০ ফুট এলাকা নদীভাঙনের মুখে পড়ে। এ ছাড়া ২০২২ ও ২০২৪ সালের বন্যায় মিয়ারপাড়া, সন্দ্রাবাজ ও শালন এলাকায় নদীভাঙনে কুলাউড়া উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। জমে থাকা পলির কারণে নদীর তলভাগ ভরাট হয়ে মনু নদ নাব্য হারাচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, দীর্ঘদিন থেকে নদ খনন না করায় দেশীয় মাছের যেমন উৎপাদন কমেছে, তেমনি কৃষকসহ আশপাশের এলাকার মানুষ নানা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

নদীতীরবর্তী এলাকার স্থানীয় কৃষক তাজু মিয়া, মোবারক আলী, ইসমাইল আলী, আব্বাস আলী ও ফরিদ আহমদ জানান, পলির কারণে মনু নদ ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন থেকে খনন না করায় বর্ষায় নদীর পানি বেড়ে গেলে বন্যার কবলে পড়তে হচ্ছে। এ জন্য কৃষিজমি ও ফসলের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া এই নদে একসময় ব্যাপক দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে মৃতপ্রায় নদনদীগুলোয় মাছের উৎপাদন কমে গেছে।

মনু নদের রাজাপুর খেয়াঘাটের মাঝি রুবেল আলী ও ধলিয়া ঘাটের মাঝি হারুন মিয়া বলেন, এখন আর আগের মতো গভীরতা নেই। পলি জমায় নদের গভীরতা কমে গেছে। নৌকা চালানো যায় না। শুকনো মৌসুমে বাঁশের সাঁকো দিয়ে ও হেঁটে এলাকার লোকজন চলাচল করেন। বর্ষায় পানি বাড়লে বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে উথলে যায়।

কুলাউড়া উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা আবু মাসুদ বলেন, ‘পলিমাটির কারণে প্রতিবছর মনু, ফানাই ও হাকালুকিতে বিল ভরাট হওয়ায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এ জন্য দেশীয় মাছের উৎপাদনও কমেছে। মনু নদের ভারতীয় সীমান্তের উপরিভাগ থেকে কটারকোনা সেতু, ফানাই নদ ও হাকালুকি হাওরের কুলাউড়া অংশের কাংলী বিল খননের প্রস্তাব মৎস্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।’ 

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন ওয়ালিদ বলেন, ‘মনু নদের কয়েকটি স্থানে বিগত সময় জমে থাকা পলি অপসারণ করা হয়েছে। দুবারের বন্যার পর নতুন করে জাগানো চরগুলো অপসারণ ও নদ খননের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি প্রস্তাব আকারে পাঠানো হবে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন জানান, জমে থাকা পলি অপসারণ, বেড়িবাঁধ মেরামত ও নদ খননের জন্য স্থানীয়রা একটি আবেদন দিয়েছেন। নদের নাব্য ফেরাতে ড্রেজিং ও খননের বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।

গজভাগ গ্রামের মৎস্যজীবী মখলিস মিয়া জানান, আগে মনুতে জাল দিলেই মাছ মিলত। এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। নদের গভীরতা কমে যাওয়ায় মাছের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে। পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মাছের বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে।

পরিবেশবাদী ফয়জুল হক বলেন, দেশের প্রতিটি নদ-নদী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের নদীগুলো সংকটের মুখে রয়েছে। মানুষ যেমন সেগুলোকে ধ্বংস করছে, তেমনি প্রকৃতিও বিরূপ হয়ে উঠেছে। মনু নদের মতো জলাশয় বিলুপ্ত হলে তা কুলাউড়ার প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। নির্ধারিত সময়ে নদী খনন ও পার সংরক্ষণের মাধ্যমে মনুর প্রবাহকে সাবলীল করার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নদী গবেষকদের সহায়তা নিয়ে এই নদে প্রাণ ফেরাতে না পারলে তা পুরো অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক স্থিতি নষ্ট করবে। সেই সঙ্গে দুই পারের জনবসতি বিলীন হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।