
প্রায় আড়াইশ বছর আগে নীলকরদের সীমাহীন শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রংপুর অঞ্চলে কৃষকরা ‘নীল বিদ্রোহ’ করলেও মুছে যাচ্ছে সেই নীলচাষের গল্প। শোষণের বদলে কৃষকদের কপাল পোড়া ‘নীল’ এখন এই অঞ্চলে সম্ভাবনার উঁকি দিচ্ছে। পতিত জমি, জমির আইল, অনাবাদী জমিতে নীল চাষে এখন খুলছে কৃষকের ভাগ্য। মাত্র ৮০ দিনেই ঘরে ঢুকছে কাড়ি কাড়ি টাকা। ঘরের জ্বালানির চাহিদা মিটিয়ে আবাদি জমির জৈবসারের চাহিদাও মিটছে।
স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, রংপুর অঞ্চলের প্রাকৃতিক এই ‘নীল’ উন্নতমানের হওয়ায় দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে। সরকার উদ্যোগে নিলেই এই অঞ্চল থেকে প্রতি বছর শুধু নীল থেকেই ২০০ কোটির উপরে আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
জমিদারদের অত্যাচারে কৃষক বিদ্রোহের কারণে ১৮৫৯-১৮৬০ সালের দিকে এই নীলচাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলেও বংশ পরস্পরা ‘মালগাছ’ হিসেবে পরিচিত ছিল এই নীল।
তবে, রংপুরের তরুণ উদ্যোক্তা নিখিল রায়ের হাত ধরে ২০০৫ সাল থেকে রংপুর সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর ও গঙ্গাচড়া উপজেলার পাগলাপীরের হরকলি ঠাকুরপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় চাষ শুরু হয়। ২০০৭ সালে শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে। বর্তমানে রংপুর ও নীলফামারীর বেশ কয়েকটি এলাকায় ব্যাপকভাবে এই নীল চাষ করছেন চাষিরা। গড়ে উঠেছে নীল ‘কারখানা’।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ২০২৪ সালে রংপুর সদর ও তারাগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলার ২০টি গ্রামে ১০ হেক্টর ও নীলফামারী উপজেলার কিশোরগঞ্জে ১৬ হেক্টর জমিতে এই নীল চাষ করেছেন ৫১২ জন কৃষক। তবে চলতি বছরের তালিকা নেই কৃষি বিভাগের কাছে।
সরেজমিনে রংপুর সদরের গঞ্জিপুর, খলেয়া ও চন্দনপাঠ এলাকায় বিস্তীর্ণ পতিত জমি, জমির আইল ও অনাবাদী জমিতে এই নীল চাষ করতে দেখা গেছে চাষিদের।
কৃষকরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সড়কের পাশের খালি জায়গাতেও নীল চাষ হচ্ছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি নীলের বীজ বুনতে হয়।
ধঞ্চেগাছের মতো এই গাছে তেমন যত্নের প্রয়োজন নেই। ৮০-৯০ দিনের মধ্যে পাতা কাটার উপযোগী হয়। তিনবার গাছ থেকে পাতা কাটা হয়। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বীজ সংগ্রহের জন্য গাছগুলো জমিতেই থাকে।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল লতিফ বলেন, জৈব সার ও জ্বালানির প্রয়োজনে ১০/১২ বছর আগে বাড়ির পাশে পতিত জমিতে মালগাছ হিসেবে চাষ শুরু করি। অনেকেই এই চাষ করেন। আমি এবার ৫৯ শতক জমিতে চাষ করেছি।
তিনি বলেন, আলু ও তামাক ওঠার পর আমন চাষের আগে যে জমি অব্যবহৃত থাকে তাতে এই ‘মালগাছ’ বা নীল চাষ করি আমরা। জমি এখন আর পড়ে থাকছে না। নীলের উপরি অংশের পাতা ২-৩ বার কেটে নীল উৎপাদনের জন্য বিক্রি করা হয়। নিচের পাতা ও ডাল দিয়ে জৈব সার হয়। তাতে জমির উর্বরতা বাড়ে, আবাদও ভালো হয়।
স্থানীয় চাষি তরিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের আশপাশের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অনেক গ্রামে ব্যাপক নীল চাষ হচ্ছে। খরচ কম, ফেলে রাখা জমিতে দোনে (২৫ শতক) ৭-৮ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে, এই কারণে অনেকেই চাষ করছে নীল।
রংপুরের পাগলাপীর এলাকার কৃষক ও স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি এবার ৫ দোন জমিতে এই নীল চাষ করেছি। আবার অনেকের জমি লিজ নিয়েছি। গেল কয়েক বছর ধরে আমি এর সঙ্গে জড়িত। বেশ লাভবান হচ্ছি।
তিনি বলেন, এক দোন জমিতে নীল চাষ করে তার খরচ হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। এখান থেকে তিনবার নীলের পাতা বিক্রি করা যায়। তাতে আয় হয় ৪-৫ হাজার টাকা। প্রথমবার নীল চাষের পর পরবর্তী চাষে জমিতে সারও খুব কম দিতে হয়।
কৃষকরা আরো জানান, ২০০৭ সালে রংপুর সদরের হরকলিতে একটি কারখানা তৈরি হয়েছে। সেখানেই তারা নীলের পাতা কেজিতে পাঁচ টাকা দরে বিক্রি করেন।
ইন্ডিগো ফিড লি. পরিচালক ও উদ্যোক্তা নিখিল রায় বলেন, রংপুর অঞ্চলে মাটির যে উর্বরতা এই মাটিতে নীল চাষে ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ দিচ্ছি। এই নীল অর্থকরী ফসল বা দামি ফসল। কৃষকেরা নীল চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমরা এ বছর ২০০ একরের বেশি জমি লিজ নিয়ে চাষ করেছি।
তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্পে যে কিং অব কালার সেটা এই নীল থেকে নেওয়া হয়। সারাবিশ্বে নীলের চাহিদা আছে। বাংলাদেশে এটা খুব ভালো মানের হয়। পাতা থেকে নীল তৈরির পর গ্রেড-এ, গ্রেড-বি, গ্রেড-সি মানের আলাদা করি। প্রাকৃতিক কালারের জন্য ফ্যাক্টরির মালিকরা আমাদের কাছে এটা কিনে। প্রতি বছর চাহিদা ৪ টন, বাহিরে থেকে অর্ডার আসলে ৫ টনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রতি বছরে দেড় থেকে দুই টন নীল তৈরি হয়ে থাকে রংপুর অঞ্চলে।
এই উদ্যোক্তা বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে ক্যানেলগুলো আছে সেগুলোসহ সরকারের বিভিন্ন পতিত জমি আছে যেগুলোতে নীল চাষের জন্য লিজ দিলে বছরে অন্তত ২০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব এই নীল থেকে। উৎপাদিত প্রাকৃতিক এ নীল রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশে। অনেক চাহিদা রয়েছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় সামান্য পরিমাণে নীল চাষ হচ্ছে। সেগুলো ব্যক্তি পর্যায়ে। ব্যাপকভাবে নীল চাষে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এটা নিয়ে গবেষণা হতে হবে। সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পজিটিভ মন্তব্য দিলেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে। তবে, শুনেছি ভালো চাষ হচ্ছে। সূত্র: কালের কণ্ঠ