ঢাকা   সোমবার
২০ অক্টোবর ২০২৫
৪ কার্তিক ১৪৩২, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

পোকা চাষ করে শিমুলের আয় মাসে ২ লাখ টাকা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:১৫, ২০ অক্টোবর ২০২৫

পোকা চাষ করে শিমুলের আয় মাসে ২ লাখ টাকা

পাবনার আটঘরিয়ার পারসিধাই গ্রামের যে শিমুল হোসেন এক সময় সবার কাছে ছিল অবহেলার পাত্র; সেই শিমুলই এখন সমাজের সবার আইডল! পোকা চাষ করে মাত্র চার বছরে পরিশোধ করেছেন ১৬ লাখ টাকার ঋণ। নিজ এলাকা আর কক্সবাজারে গড়ে তুলেছেন আরও দুটি নতুন খামার। সব খরচ বাদ দিয়ে এখন মাসে তাঁর আয় দেড় থেকে ২ লাখ টাকা।

শিমুলের কাছে এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই দেখতে মাছির মতো। এটি মূলত মাছিজাতীয় প্রাণীর লার্ভা। আকারে মাছির তুলনায় কিছুটা লম্বা। ময়লা-আবর্জনা, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ও হোটেলের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা মূলত ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নামক পোকার খাবার। মাছ ও পোলট্রির প্রচলিত খাদ্যের বিপরীতে ব্ল্যাক সোলজারই আগামীর বিকল্প। কারণ, এর পুষ্টিমান ও খরচ তুলনামূলক কম। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রয়েছে এর ব্যাপক অবদান।’

এক সময় হতাশায় ডুবে যেতে বসা শিমুলের মতো আরও অনেক উদ্যোক্তা এখন পোকার খামার করে জীবন-সংসারের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। পাবনার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্যাশন ডিজাইনে ডিপ্লোমা শেষ করে ঢাকায় চাকরি করতেন শিমুল। মূলত তখন থেকেই কৃষিতে নিজে কিছু করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। চাকরিতে তেমন সুবিধা করতে না পেরে ২০১৮ সালে বাড়িতে এসে হাঁস পালন শুরু করেন। নতুন হওয়ায় ১৮ লাখ টাকা ঋণের মধ্যে পড়েন।

তবে ইউটিউব ভিডিও দেখে ব্ল্যাক সোলজার চাষের আগ্রহ হয় তাঁর। এরপর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নেন শিমুল। বাজার ব্যবস্থার খোঁজখবর নিয়ে নেমে পড়েন মাঠে। এর মধ্যে পাবনার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রোগ্রাম ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট বা পিসিডি বাস্তবায়িত রুরাল মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট থেকে ঋণ ও আবার নতুন করে প্রশিক্ষণ নেন। এ ছাড়া পিসিডির মার্কেট চেইন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ান শিমুল। প্রতিদিন ৩০০ কেজি, যার বাজার মূল্য ৮০ টাকা কেজি ধরে ৭২ হাজার টাকার লার্ভা উৎপাদন করেন। এগুলো বিক্রি করেন স্থানীয় বাজার ও ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে। এভাবে শিমুল এখন কক্সবাজারে প্রায় ৩০ লাখ টাকায় বড় আকারের ফার্ম গড়ে তুলেছেন। 

তরুণ এই উদ্যোক্তার কাছে জানতে চাইলে সাহসকে বলেন, ‘পোকা চাষের কারণে স্থানীয়রা এক সময় আমাকে পাগল বলতো। কিছুদিন আগে আমি ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানে মাদার পোকা-পিউপা রপ্তানি করেছি। উদ্যোক্তারা ওই সব দেশেও এই পোকার খামার করেছেন।’ পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার বলেন, ‘প্রচলিত বাজারে মাছ ও পোলট্রি খাবারের প্যাকেটে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ প্রোটিন থাকে। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ে প্রোটিনের পরিমাণ ৪৩ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। এ কারণে দেশে ক্রমেই মাছ ও পোলট্রির খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে এই পোকা। এর উৎপাদন খরচও কম। এক কেজি পোকার উৎপাদন খরচ ১০ থেকে ১২ টাকা। বিক্রি হয় সময়ভেদে ৫০ থেকে ৮০ টাকা কেজি ধরে।’

কৃষিবান্ধব অর্থনীতি কিংবা গ্রামীণ সমাজ উন্নয়নে শিমুলের মতো উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানান পাবনার পিসিডি নির্বাহী পরিচালক মো.শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা পেয়ে শিমুল এখন দেশসেরা ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই উৎপাদনকারী। এমন অসংখ্য উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছি আমরা। তাদের হাত ধরে আগামীর গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই তার উদাহরণ মাত্র।’

চাষ পদ্ধতি 
ব্ল্যাক সোলজার কিছুটা শক্ত খোলসযুক্ত। মূল পোকাগুলো একটি জালের মধ্যে, দিনের বেলায় আলো-বাতাস আসে এমন জায়গায় রাখা হয়। পোকাগুলো প্রজনন সম্পন্ন করার পর সেখানে কাঠের স্তরের মধ্যে ডিম পাড়ে। সেই ডিম হ্যাচিং করে ফোটানোর আট থেকে ১০ দিন পর আলাদা করে অন্য জায়গায় রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে তৈরি হয় লার্ভা। ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এই লার্ভা দেখতে পোকার মতো হয়, যা মাছ, হাঁস বা মুরগিকে খাবার হিসেবে দেওয়া হয়। ২০ থেকে ৩০ দিন পর লার্ভাটি থেকে গেলে পরে তা মাছিতে পরিণত হয়। একেকটি প্রাপ্ত বয়স্ক মাছির জীবনকাল হয় ৮ থেকে ১০ দিন। প্রতিটি ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই ৯০০ থেকে ১ হাজার পিউপা দিয়ে মারা যায়। এই পোকা ফিশারিজ ও পোলট্রি শিল্পের জন্য আগামীতে আশীর্বাদ হবে বলে জানান এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। ব্যাপক প্রোটিনসমৃদ্ধ এই খাবার খাওয়ালে কম খরচে মাছ ও পোলট্রির উৎপাদন বাড়বে। এর মাধ্যমে বায়োটেকনোলজি, সার ও ভালো প্রোটিন পাওয়া যাবে। এই পোকা পরিবেশ বান্ধবও।

আগামীর ভাবনা
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে শিমুল হোসেন বলেন, ‘দেশের ২৫ জেলায় ২৮০ জনের বেশি উদ্যোক্তা বাণিজ্যিকভাবে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই চাষ করছেন। তাদের সহ দেশের বাইরেও আমি এখন রপ্তানি করছি! তাই বলি, কেবল দেশে নয়; আগামীতে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই-এর উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাই।’