বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ আহরণের স্বপ্ন ভেস্তে যাচ্ছে। ২০২০ সালে হাতে নেওয়া এই পাইলট প্রকল্প এখন অচল হয়ে পড়েছে। কথা ছিল দুটি জাহাজ কেনা হবে; কিন্তু একটিও কেনা যায়নি। প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফা বাড়ানো হলেও অর্জন শূন্য। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের পরও সমুদ্রে একদিনের জন্যও জাহাজ নামতে পারেনি। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে টুনা মাছ ধরার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে।
পাঁচ বছরে শূন্য অর্জন, প্রকল্পে অপচয়
২০২০ সালের জুনে ‘গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণ’ শীর্ষক পাইলট প্রকল্প হাতে নেয় মৎস্য অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের আওতায় গভীর ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় কী পরিমাণ টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আছে এবং বাংলাদেশের মৎস্য ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় মাছ ধরতে পারবেন, সে বিষয়ে গবেষণা হবে। যাতে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা জাহাজ কিনে গভীর সাগরে বা আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরতে উদ্বুদ্ধ হন।
প্রকল্পের দপ্তর জানিয়েছে, প্রথমে এর মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সে সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬১ কোটি টাকা। পরে প্রস্তাব সংশোধন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন করা হয়। ব্যয় কমিয়ে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। তিনটির বদলে দুটি জাহাজ কেনার কথা বলা হয়। সেই জাহাজ আর কেনা হয়নি। এর পর চলতি বছর প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয় এবং ব্যয় কমিয়ে ৪১ কোটি ৪ লাখ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি মাত্র ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ। জাহাজ কিনতে ২১ কোটি টাকার এলসিও খোলা হয়েছিল। তা ছাড়া এ পর্যন্ত সমুদ্রে কোনো সমীক্ষাও পরিচালনা করা হয়নি। কোনো তথ্যভান্ডার তৈরি হয়নি। সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে একটি লক্ষ্যও পূরণ হয়নি। উল্টো জাহাজ কেনার আগেই জাহাজের জন্য তিনটি ডিজিটাল ক্যামেরা কেনা হয়েছে প্রকল্পের টাকায়। এতে ব্যয় হয়েছে ১১ লাখ টাকা।
ব্যর্থ দরপত্র, রাজনৈতিক প্রভাব
প্রথমবার ২০২১ সালের মার্চে জাহাজ কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। তিনটি দরপত্র এলেও কোনোটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। একই বছর আগস্টে আবারও দরপত্র আহ্বান করা হলে সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউনি মেরিন প্রাইভেট লিমিটেড কাজ পায়। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির এজেন্ট ছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদারের মালিকানাধীন কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডি। কিন্তু জাহাজ আমদানিতে সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘ সময় আটকে থাকে কাজ। ২০২৪ সালের মে মাসে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য অধিদপ্তরের সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চীন গিয়ে জাহাজ পরিদর্শন করে। সেখানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১০ বছরের পুরোনো ইঞ্জিনের নিম্নমানের জাহাজ দেখায়।
প্রকল্পের পরিচালক ড. জুবায়দুল আলম বলেন, দরপত্রে নতুন জাহাজ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা পুরোনো জাহাজ চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। আমরা অস্বীকৃতি জানালে লিয়াকত সিকদার অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেন। এই জাহাজ নিলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হতো এবং পরে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হতো। এবার আর জাহাজ কেনা হবে না। বরং বিদেশি একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে জাহাজ ভাড়া নিয়ে তাদের মাধ্যমে গবেষণা করা হবে এবং পরে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ওই পুরোনো জাহাজ নিতে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান প্রকল্প কর্মকর্তাদের চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্মকর্তারা রাজি না হওয়ায় প্রকল্প কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুর রউফ বলেন, প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এখন টুনা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কার্যক্রম সম্প্রসারণের চেষ্টা করছি।
মাছ না ধরলেও দিতে হচ্ছে টাকা
বঙ্গোপসাগরের প্রায় দুই লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে আছে দেশের সমুদ্রসীমা। এর মধ্যে ২০ শতাংশ উপকূলীয়, ৩৫ শতাংশ অগভীর সাগর, আর ৪৫ শতাংশ গভীর সাগর। আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রবেশেরও অধিকার আছে বাংলাদেশের। গভীর সমুদ্রে টুনা বা সমজাতীয় পেলাজিক মাছ ধরতে লং লাইনার ও পার্সসেইনার ধরনের আধুনিক জাহাজের প্রয়োজন হয়। অথচ বাংলাদেশে এ ধরনের জাহাজ নেই। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে একটি পর্যালোচনা সভা হয়।
সভা সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার জন্য ১৯টি লং লাইনার ও পার্সসেইনার ধরনের জাহাজ কেনার অনুমতি দিয়েছিল মৎস্য অধিদপ্তর। কিন্তু একটিও কেনা হয়নি। বাংলাদেশে মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয়– কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই টুনা বা অন্যান্য পেলাজিক মাছের ঐতিহাসিক, জৈবিক, প্রজনন কিংবা চলাচল (মাইগ্রেটরি) সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অবস্থায় হুট করে জাহাজ কেনার অনুমতি দেওয়াটাই ছিল অযৌক্তিক।
২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) পূর্ণ সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক জলসীমায় (বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের অংশে) মাছ ধরার অধিকার তৈরি হয়। কিন্তু সদস্যপদ নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরতে নামেনি। অথচ প্রতিবছর ফি দিতে হচ্ছে প্রায় ৭৭ লাখ টাকা।
আইওটিসির সদস্যদেশ হিসেবে বাংলাদেশ সংস্থাটির কাছ থেকে নানান তথ্য পাচ্ছে– কোন দেশ কত মাছ ধরছে, কী প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ইত্যাদি। তবে বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, সরাসরি সদস্য না হয়ে পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবেও এই তথ্য পাওয়া যেত। তাতে অর্থ ব্যয়ের চাপ কম হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই অধিদপ্তর হুট করে আইওটিসির সদস্যপদ নিয়ে নেয়। আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার সক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে এখন মাছ ধরা ছাড়াই টাকা দিতে হচ্ছে। কিছু কর্মকর্তার বিদেশ সফর ও বাহবা কুড়ানোর জন্যই মূলত এটা করা হয়েছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক কাজী আহসান হাবীব বলেন, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে হলে আগে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। কোথায় টুনা আছে, কখন তারা প্রজনন করে, তাদের চলাচলের ধারা কী– এসব আগে জানতে হবে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ কিংবা ভারত টুনা আহরণ ও রপ্তানিতে এগিয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশ এখনও প্রাথমিক ধাপেই আটকে আছে। সূত্র: সমকাল























