ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সিংরাউন্দ গ্রামের ৩৯ বছর বয়সী শেফালী বেগম। করোনাকালে স্বামীর আয়ে ধস নামায় পরিবারসহ তীব্র খাদ্যসংকট, ঋণ ও অনিশ্চয়তায় পড়েছিলেন। এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে তাঁর জীবনে সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয় সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের রেজিলিয়েন্স, এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড লাইভলিহুড ইমপ্রুভমেন্ট (আরইএলআই) প্রকল্প।
২০২২ সালে আরইএলআই প্রকল্পে যুক্ত হয়ে শেফালী বেগম সঞ্চয় শুরু করেন। একই সঙ্গে নেতৃত্ব উন্নয়ন, হিসাব ব্যবস্থাপনা ও হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এক পর্যায়ে প্রকল্প থেকে ৪ শতাংশ সুদে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২০০ মুরগি নিয়ে ছোট ব্রয়লার খামার শুরু করেন। প্রথম ব্যাচে মাত্র ২৮ দিনে তিনি লাভ করেন ১৮ হাজার টাকা। এরপর কয়েক ব্যাচে তাঁর লাভ দাঁড়ায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা।
২০২৩ সালে আরও ৫০ হাজার টাকা ঋণে তিনি ১ হাজার মুরগির খামার স্থাপন করেন। ভালো পারফরম্যান্সের কারণে ২০২৪ সালে বিশেষ বিবেচনায় আরও এক লাখ টাকা ঋণ পান। সেই অর্থে স্বামীর জন্য একটি ইজিবাইক কেনেন, যা থেকে এখন দৈনিক গড়ে ৫০০ টাকা আয় হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অফিসের সহায়তায় তিনি ক্যাম্বেল হাঁস পালন করেন। হাঁস বিক্রি ও ডিম উৎপাদন মিলিয়ে লাভ হয় বছরে প্রায় ২ লাখ টাকা। নিজের আয়ে তিনি একটি আধাপাকা ঘরও তৈরি করেছেন। দারিদ্র্যের দীর্ঘ লড়াই পেরিয়ে আজ শেফালী বেগম আত্মনির্ভরতা, সাহস ও সাফল্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িছেন। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের আরও অনেকে হাঁস-মুরগির খামারে যুক্ত হচ্ছেন। শেফালীর ভাষায়, ‘এসডিএফ না এলে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত। অথচ এখন তিনি ওদের সুখের ভবিষ্যৎ দেখছেন।’
শুধু শেফালী বেগমই নন, গত চার বছরের বেশি সময়ে আরইএলআই প্রকল্প থেকে ৫ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ নানাভাবে সুবিধা পেয়েছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৫৭ জনের আয় অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে; যা এ প্রকল্পের মধ্যবর্তী লক্ষ্যের প্রায় দ্বিগুণ। ২০২১ সালে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে এ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংক থেকে দুই শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে দরিদ্রদের সহায়তায় অনুদান হিসেবে এ অর্থ এসডিএফকে দেয় সরকার। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প শেষ হবে আগামী বছরের মে মাসে।
সম্প্রতি এ প্রকল্পের মধ্যমেয়াদি প্রতিবেদনের ওপর একটি স্বাধীন পর্যালোচনা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)। এ পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমার অগ্রগতি গত কয়েক দশক ধরে উল্লেখযোগ্য হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা উল্লেখযোগ্যভাবে মন্থর হয়েছে। এ পরিস্থিতিতেও আরইএলআই প্রকল্প উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাচ্ছে।
দ্রুত সাফল্য ও প্রভাব
মধ্যবর্তী মূল্যায়ন অনুযায়ী আরইএলআই প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসে সফলতা অর্জন করেছেন। প্রধান সূচকগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্য অতিক্রম করেছে। মোট সুবিধাভোগীর মোটের ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৫৮ জন সুবিধাভোগীর আয়ে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বেড়েছে; যা মধ্যবর্তী লক্ষ্যের প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ সুবিধাভোগীর দারিদ্র্য স্তর পরিবর্তন হয়েছে। যেমন–হতদরিদ্র থেকে দরিদ্র বা দরিদ্র থেকে অ-দরিদ্র হয়েছেন। ৩ হাজার ৮২৮ জন উদ্যোক্তা সহায়তা পেয়েছেন, তাদের আয় ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এছাড়া কমিউনিটি পর্যায়ে সংহতি এবং আর্থিক শৃঙ্খলায়ও বড় অগ্রগতি দেখা গেছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সঞ্চয়ে অংশগ্রহণ হার ২৫.৪% থেকে বেড়ে ৯৮.৪% হয়েছে।
নারী নেতৃত্বে সাফল্য
আরইএলআই প্রকল্পের অন্যতম মূল সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দু হলো নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ এখনও সীমিত। যেসব ব্যক্তি আয় বাড়িয়েছেন, দারিদ্র্য কমিয়েছেন এবং স্থিতিস্থাপকতা উন্নত করেছেন, তাদের ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশ নারী। দ্বিতীয় স্তরের কমিউনিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বে ৮৫ শতাংশ পদে রয়েছেন নারী। আয় বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং আচরণগত পরিবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সহায়তা কমিটি এবং আচরণ পরিবর্তন প্রচারণার মাধ্যমে মৌলিক স্বাস্থ্য অনুশীলনে দ্রুত উন্নতি এসেছে। এর ফলে দরিদ্র পরিবারের স্বাস্থ্য ব্যয় কমেছে। অসুস্থতার হার উল্লেখযোগ্য কমেছে।
লক্ষ্যভিত্তিক দারিদ্র্য নিরসন
এ প্রকল্পের সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, দারিদ্র্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে উপকারভোগী নির্ধারণ করে সদস্যদের সমিতি। তাই যোগ্যদের হাতে অর্থ বণ্টন সম্ভব হয়। প্রকল্পটি উচ্চ দারিদ্র্যপ্রবণ ২০টি জেলার পাঁচটি অঞ্চলে কার্যক্রম চালায়। এলাকা নির্বাচনে খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ৩০ শতাংশের বেশি দারিদ্র্য হারকে মানদণ্ড হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পটির চারটি মূল উপাদানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এগুলো হচ্ছে–ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের মাধ্যমে অর্থায়ন; আয়বর্ধক কার্যক্রমের জন্য নগদ অর্থ স্থানান্তর এবং ঋণ প্রদান; দ্বিতীয় স্তরের কমিউনিটি প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং বাণিজ্যিক কৃষি ও গ্রামীণ উদ্যোক্তা উন্নয়ন।
এসডিএফ চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, এ প্রকল্প দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক অবদান রাখছে। যেসব নারী ভালোমতো কথা বলতে পারত না, তারাও এ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পাশাপাশি নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছেন। প্রকল্পটির চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঋণ নিয়ে অর্থায়ন করতে হচ্ছে। ঋণ নিয়ে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার অনেক ঝুঁকি থাকে।























