ঢাকা   শুক্রবার
২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
১১ পৌষ ১৪৩২, ০৬ রজব ১৪৪৭

দৌলতপুরে শতকোটি টাকার তুলা চাষ

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫

দৌলতপুরে শতকোটি টাকার তুলা চাষ

ছোট ছোট গাছের ডালে তুলা ফুটে আছে। দূর থেকে মনে হয় সাদা রঙের কোনো ফুল। গাছ থেকে সেই তুলা তুলে গলায় ঝোলানো ঝোলায় রাখছেন নজরুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন শ্রমিক। ঝোলা ভর্তি হয়ে গেলে তুলা নিয়ে বড় বস্তায় জমা করছেন তারা। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মাঠে মাঠে এখন এমনই তুলা তোলার ধুম। নজরুলের মতো প্রায় দুই হাজার কৃষক তুলা উত্তোলনের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

দৌলতপুরের আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, আশির দশক থেকে তুলা চাষ করছে তাঁর পরিবার। ১৯৮১ সালে তৎকালীন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় ইউনিট অফিসার বদর উদ্দীনের পরামর্শে তাঁর বাবা খেজের আলীসহ কয়েক কৃষক ধর্মদহ গ্রামে ছোট পরিসরে তুলা চাষ করেন। সেই থেকে উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে এই ফসল চাষ শুরু। নজরুল প্রতিবছর চার-পাঁচ বিঘা জমিতে তুলা চাষ করেন। বিঘাপ্রতি চাষ করতে সার, বীজ, কীটনাশকসহ প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘাতে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বিক্রি করেন। এ ফসল আবাদে বর্তমানে জেলার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে দৌলতপুর। লাভজনক ও অর্থকরী ফসল হওয়ায় তুলার উৎপাদন বাড়ছে।

সবচেয়ে বেশি তুলা দৌলতপুরে
কুষ্টিয়া তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, চলতি বছর কুষ্টিয়া অঞ্চলে (কুষ্টিয়া-মেহেরপুর জেলায়) চার হাজার ৯০০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে তুলা চাষ হয়েছে চার হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে শুধু দৌলতপুরেই চাষ হয়েছে দুই হাজার ৪৩৪ হেক্টর। দেশের সবচেয়ে বেশি তুলা চাষ হয় দৌলতপুরে।

বোর্ড সূত্র আরও জানিয়েছে, বর্তমানে ৮৫ লাখ বেল (পৌনে চার কোটি মণ) তুলার চাহিদা রয়েছে। প্রতি বেলে ১৮২ কেজি তুলা থাকে। কিন্তু দেশে তুলা উৎপাদন হয় মাত্র দুই লাখ বেল (৯ লাখ ১০ হাজার মণ)। এর বাজারমূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে কুষ্টিয়া জেলাতে উৎপাদন হয় প্রায় ২০৯ কোটি টাকার। দৌলতপুর উপজেলায় উৎপাদন হয় ১০০ কোটি টাকার। প্রতি মণ তুলার দাম প্রায় চার হাজার টাকা।

চাষ পদ্ধতি
স্থানীয় কৃষক ও তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, সাধারণ ও মালচিং বেড পদ্ধতি– দুইভাবেই জমিতে তুলার বীজ বপন করা যায়। এক ফুট দূরত্বে সারি সারিভাবে বীজ বপন করা হয়। প্রতি বিঘায় রোপণ করা হয় প্রায় তিন হাজার চারা। দৌলতপুরে মূলত হাইব্রিড জাতের উচ্চফলনশীল তুলা চাষ করেন কৃষকেরা। রুপালী-১, হোয়াইট গোল্ড-১ ও ২, ডিএম-৪ হাইব্রিড জাতের পাশাপাশি তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব সিবি হাইব্রিড ও দেশি উফশী জাতের তুলার আবাদও হয়। হাইব্রিড জাতের প্রতি কেজি বীজ তিন হাজার টাকা দরে কেনেন কৃষক।

তারা জানান, চারা রোপণ থেকে শুরু করে তুলা সংগ্রহ পর্যন্ত ছয় মাস লাগে। জুলাই ও আগস্টে বীজ বপন করা হয়। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিক থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তুলা তোলেন কৃষকেরা। সার ও সেচের পাশাপাশি নিয়মিত কীটনাশক দিতে হয়। তাই স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে তুলার সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে মরিচ, লালশাকসহ বিভিন্ন ফসলও চাষ করা হচ্ছে।

ধর্মদহ গ্রামের কৃষক আজিজুল হক বলেন, অন্য আবাদের পাশাপাশি ছোট আকারে তুলা চাষ শুরু করি। লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছর তুলা চাষ করছি। এবারও সাত বিঘা জমিতে তুলার আবাদ রয়েছে।

বাজার ব্যবস্থা
কৃষকরা জানান, সঠিক বীজ বপন ও পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতি বিঘায় গড়ে ১৪ থেকে ১৬ মণ তুলা উৎপাদন সম্ভব। বাজারজাতকরণের জন্য সরকার নির্ধারিত দরে বেসরকারি জিনিং মালিক সমিতির প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কৃষকরা সরাসরি তুলা বিক্রি করতে পারছেন। অস্থায়ী বাজার বসিয়ে তুলা বেচাকেনা চলে। ফলে মধ্যস্থতাকারীদের ওপর নির্ভরতা নেই। প্রতি মণ তুলা চার হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। 

তুলা চাষে লাভবান হলেও উৎপাদন ব্যবস্থা ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে কিছু অভিযোগ রয়েছে কৃষকদের। বড় অঙ্কের খরচ হয়ে যায় আগাছা দমন ও তুলা উত্তোলনে। তা ছাড়া একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে তুলা কেনা হয়। ফলে বিক্রয়ের বিকল্প মাধ্যম নেই। প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা থাকলে কৃষকরা আরও লাভবান হতেন।

আদাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও তুলা চাষি রুস্তম আলী বলেন, তুলা চাষে প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার। চাষের খরচের বড় অংশ চলে যায় গাছ থেকে তুলা তুলতে। তা ছাড়া শ্রমিক না পাওয়ায় সঠিক সময় তুলতে না পেরে নষ্ট হয়। সরকার প্রণোদনার মাধ্যমে হারভেস্ট ও আগাছা দমনের মেশিন সরবরাহ করলে তুলার উৎপাদন বাড়ানো যেত।

প্রণোদনা পাচ্ছেন কৃষক
তুলা চাষের উন্নয়ন, চাষিদের প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানের জন্য কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর নিয়ে ‘কুষ্টিয়া তুলা উন্নয়ন জোন’ রয়েছে। জোনে ১৫টি ইউনিট অফিসের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কুষ্টিয়ায় রয়েছে ৯টি ইউনিট, যার মধ্যে পাঁচটি দৌলতপুর উপজেলায়। তুলা চাষকে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারিভাবে প্রতিবছর কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এ বছর দৌলতপুরে দুই হাজার ৫০ কৃষককে প্রণোদনার আওতায় আনা হয়েছে।

কুষ্টিয়ার প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা শেখ আল মামুন বলেন, লাভজনক অর্থকরী ফসল হিসেবে ধর্মদহ গ্রামে প্রচুর তুলা চাষ হচ্ছে। এই এলাকার প্রায় দুই হাজার মানুষ তুলা চাষে যুক্ত। কুষ্টিয়া তুলা উন্নয়ন বোর্ড স্থানীয় ইউনিট অফিসের মাধ্যমে কৃষকদের প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।

তুলার সবকিছুই কাজে লাগে
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের উপপরিচালক (সদরদপ্তর) কুতুব উদ্দীন জানান, তুলা দিয়ে প্রধানত সুতা তৈরি হয়। যে তুলার ফাইবার ২৮-৩২ সেন্টিমিটার, সেগুলো দিয়ে সিট কাপড় তৈরি হয়। ফাইবার ১৬-২২ সেন্টিমিটার হলে সেগুলো দিয়ে তৈরি হয় জিন্স কাপড়। তুলার বীজ থেকে তেল ও খৈল পাওয়া যায়। তুলা গাছ প্লাইউডের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া শিকড়ে ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে। তুলার পাতা জৈব সার হিসেবে খুবই কার্যকরী। অর্থাৎ তুলার সবকিছুই প্রয়োজনীয় ও অর্থকরী।

তিনি আরও জানান, তুলার ফাইবার/আঁশের ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ হয়। মূলত যুক্তরাজ্যের প্রাইমার ব্র্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে তোলা রপ্তানি হয়। কোম্পানিটি কিছু নির্বাচিত কৃষক তৈরি করেছে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ওই কৃষকদের কাছ থেকে কোম্পানিটি তুলা সংগ্রহ করে বিদেশে রপ্তানি করে। বীজ বপন থেকে শুরু করে তুলা উত্তোলন পর্যন্ত পুরো সময়টাই প্রাইমার কোম্পানির প্রতিনিধিরা ওই কৃষকদের নার্সিং করেন।

কুতুব উদ্দীন বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক দেশ। দেশের বিশাল পোশাকশিল্পের কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করতে হয়। বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে তুলার চাষ ও উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ড নানামুখী কাজ করছে। কৃষকদের সহায়তায় এ বছর ১৮ কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।