
গঠন হচ্ছে দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড। দুধের উৎপাদন বাড়ানো, মান নিয়ন্ত্রণ, ক্ষুদ্র খামারিদের সহায়তা, দুগ্ধশিল্পে সুশৃঙ্খল পরিবেশ আনা এর মূল লক্ষ্য। সরকারের গেজেট অনুযায়ী গত সোমবার কার্যকর হয়েছে ‘বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০২৩’।
এই খাতের সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, বোর্ড কার্যকর হলে দুধ উৎপাদন বাড়বে, আমদানি নির্ভরতা কমবে, কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং দেশে পুষ্টি নিরাপত্তা জোরদার হবে।
বোর্ডের কার্যক্রম আপাতত রাজধানীর ফার্মগেটে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে শুরু হবে। পরে আলাদা কার্যালয়ে নেওয়া হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, এ মাসের মাঝামাঝি বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদ গঠন সম্পন্ন হবে। এরপর প্রথম সভা বসে কার্যক্রম চূড়ান্ত হবে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরই দুগ্ধ খাত সামলায়। দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড হলে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের উন্নয়ন ও বৈচিত্র্য আনায় বিশেষ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হবে।
খামারিদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুগ্ধ বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এক যুগের বেশি সময় তা ঝুলে ছিল। ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদ আইন পাস করলেও বোর্ড কার্যকর হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তে অবশেষে বাস্তব রূপ পেল প্রত্যাশিত উদ্যোগটি।
আইন অনুযায়ী, বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী (বর্তমানে উপদেষ্টা)। সহ-সভাপতি হবেন সচিব। নির্বাহী পরিচালক থাকবেন সদস্য সচিব হিসেবে। সদস্য হবেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, অর্থ, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞানের অধ্যাপক, দুগ্ধ সমবায় ও উৎপাদক সংগঠনের প্রতিনিধি। আইন অনুযায়ী দুজন নারী প্রতিনিধি রাখাও বাধ্যতামূলক।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক এ বি এম খালেদুজ্জামান জানান, দেশে বার্ষিক দুধের চাহিদা প্রায় ১৬২ লাখ টন, উৎপাদন হচ্ছে ১৫৫ লাখ টন। ঘাটতি পূরণে প্রতিবছর ৩২০ মিলিয়ন ডলারের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা এক দশকে সাত গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, ভেজাল, দুর্বল মান নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষুদ্র খামারিদের পর্যাপ্ত প্রণোদনার অভাব খাতটিকে পিছিয়ে দিয়েছে। তাঁর আশা, বোর্ড কার্যকর হলে খাতটি আধুনিক আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিল্পে রূপ নেবে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ এমরান বলেন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) হিসেবে ভারত এখন দুধ উৎপাদনে শীর্ষে। দেশটির এই অবস্থানে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড। বাংলাদেশে এই বোর্ড গঠনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলাম। অবশেষে খামারিদের দাবি পূরণ হয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান মনে করেন, সঠিক নেতৃত্ব ও প্রণোদনা থাকলে পাঁচ বছরের মধ্যে দুধে আত্মনির্ভরশীল হওয়া সম্ভব। এরপর ভারতের মতো রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে তোলা যাবে। তিনি প্রস্তাব দেন, কৃষি ও দুগ্ধ ঋণ ৪ শতাংশ সুদে দেওয়া, পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখা এবং বিদ্যুৎ ভর্তুকি ডেইরি খাতেও দেওয়া উচিত।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, এই বোর্ড দুগ্ধশিল্প উন্নয়নে কাজ করতে পারবে। দেশের মানুষের মধ্যে দুধ খাওয়ার অভ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। তাদের আগ্রহী করে তোলা, উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে টেকসই কাঠামো গঠনের পাশাপাশি দুধের নিরাপত্তা ও গুণগত মান উন্নয়নে বোর্ড সহায়ক হবে বলে আশা করছি।
প্যারাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, আমদানি নির্ভরতা কমাতে হলে পুরো ভ্যালু চেইনে– খামার থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত– সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণ দরকার। বোর্ড তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।