
জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার দেশে প্রথমবারের মতো ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ স্থাপন করেছে। এতে দেশীয় ৬৪ প্রজাতির বিপন্ন মাছ সংরক্ষণ করা হবে। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই) স্থাপিত এই ব্যাংক যেসব দেশীয় প্রজাতির মাছ পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি ও আবাসস্থল হারানোর বিলুপ্তির পথে, সেসব মাছের জেনেটিক সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিএফআরআই-এর মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র জানান, এ পর্যন্ত ৪০টি বিপন্ন মাছের প্রজাতি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি গত দশকের।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই উদ্যোগ সরকারের বৃহত্তর লক্ষ্য- দেশে মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
জিন ব্যাংকটি আধুনিক প্রজনন প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থানীয় মাছের দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ নিশ্চিত করবে এবং ইতোমধ্যে কৃষকদের মাঝে এই প্রযুক্তি স্থানান্তরিত হচ্ছে।
ড. অনুরাধা ভদ্র বলেন, স্থানীয় প্রজাতির মাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার মূল কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক আবাসস্থলের শুকিয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য পরিবেশগত ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত কয়েক বছরে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এই জিন ব্যাংকের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বিপন্ন মাছের জার্মপ্লাজম, অর্থাৎ জেনেটিক উপাদান সংরক্ষণ করতে পারছেন এবং নিয়ন্ত্রিত হ্যাচারি পরিবেশে এগুলো প্রজনন করে নদী, হ্রদ ও জলাভূমিতে ছাড়তে পারছেন।
বিএফআরআই-এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আশরাফুল আলম জানান, দেশের মিঠা পানির ২৬০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। এদের মধ্যে ৬৪ প্রজাতিকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জিন ব্যাংকে মোট ১৪৩ প্রজাতির জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়েছে, যার ৯৮টি ময়মনসিংহে এবং বাকিগুলো নীলফামারীর সৈয়দপুর ফ্রেশওয়াটার সাবস্টেশনে সংরক্ষিত।
বিএফআরআই-এর আরেক সিনিয়র বৈজ্ঞানিক ড. মোহাম্মদ মাশিউর রহমান জানান, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পদ্ধতির মধ্যে কৃত্রিম প্রজনন কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি দ্রুত প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে এবং তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে পুনঃস্থাপন করতে সাহায্য করে। যদি কোনো প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে হ্যাচারি-ভিত্তিক প্রজননের মাধ্যমে এটিকে পুনরুদ্ধার করা যাবে এবং প্রাকৃতিকভাবে পুনর্জন্মের জন্য পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া যাবে।
বাংলাদেশিদের খাদ্যাভ্যাসে মাছ একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এটি দেশের বার্ষিক প্রোটিন চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ পূরণ করে। মাছ উচ্চমানের প্রোটিন, প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিন এ ও ডি, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, সেলেনিয়াম এবং আয়োডিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের উৎস।
সহজে হজমযোগ্য প্রোটিন প্রোফাইল থাকার কারণে মাছ গ্রামীণ ও শহুরে দুই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের মৎস্য খাত ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে দেশে মাত্র ৭ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছিল। ২০২০-২১ সালে তা ৪.৬২ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছে।
বর্তমান মৎস খাত জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ৩.৫৭ শতাংশ অবদান রাখছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের জীবিকা নির্বাহে সহযোগিতা করছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫০টিরও বেশি দেশে মৎস ও মৎস সংশ্লিষ্ট পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৫৩৩ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১ শতাংশেরও বেশি।
এই সফলতার পরও স্থানীয় চাহিদায় মিঠা পানির মাছের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। মাত্র দুই দশক আগে দেশে মাছের চাহিদা ৮০ শতাংশ স্বাদু পানির মাছে পূরণ হতো। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে প্রায় ৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কারণ মৎস্যচাষীরা অভ্যন্তরীণ এবং রপ্তানি বাজারের উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন প্রজাতির মাছ চাষে মনোযোগী হয়েছেন। তবে বিএফআরআইয়ের সংরক্ষণমূলক উদ্যোগের কারণে ধীরে ধীরে এই প্রবণতা বিপরীত দিকে যাচ্ছে।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রশীদুল হাসান পর্যবেক্ষণ করেছেন, কৃষকরা দেশীয় ছোট মাছ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। কারণ এসব মাছ চাষে খরচ কম হয় এবং বাজারে এর মূল্য বেশি। বাংলাদেশি পাবদা মাছ, কৈ মাছ, এবং টেংরা প্রজাতির মাছগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুনরুদ্ধার হয়েছে এবং এখন এসব মাছ ব্যাপকহারে উৎপাদিত হচ্ছে।
২০০৯ সাল বাংলাদেশে ছোট মাছের উৎপাদন ছিল প্রায় ৬৭ হাজার টন। ২০২১ সালে উৎপাদন বেড়ে ২ লাখ ৬১ হাজার টনে পৌঁছেছে, যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বগুড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডেভিড রিন্টু দাস বলেন, এ ধারা অব্যাহত রাখতে এবং বিস্তার করতে বিএফআরআই বিভিন্ন স্বল্প-মেয়াদি, মধ্য-মেয়াদি, এবং দীর্ঘ-মেয়াদি প্রকল্প শুরু করেছে। এর লক্ষ্য হলো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিভিন্ন বিপন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করার সক্ষমতা অর্জন করা। এসব কর্মসূচি দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণই নয়, বরং জাতির সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত ঐতিহ্য রক্ষায়ও কাজ করবে।