ঢাকা   মঙ্গলবার
১৪ অক্টোবর ২০২৫
২৮ আশ্বিন ১৪৩২, ২১ রবিউস সানি ১৪৪৭

শৈবাল থেকে মজাদার মিষ্টি, পবিপ্রবি মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের গবেষণা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১২ অক্টোবর ২০২৫

শৈবাল থেকে মজাদার মিষ্টি, পবিপ্রবি মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের গবেষণা

পরীক্ষাগারের জানালা দিয়ে বিকেলের নরম আলো এসে পড়েছে সবুজ শৈবালের ওপর। টেবিলজুড়ে শুকনা শৈবালের স্তূপ, পাশে রঙিন বোতলে তরল নির্যাস। বাতাসে হালকা নোনা গন্ধ। এমন পরিবেশে ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েকজন তরুণ গবেষক।

কেউ শৈবাল শুকাচ্ছেন, কেউ তা গুঁড়া করে প্যাকেটজাত করছেন।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের মৎস্য জীববিজ্ঞান ও কৌলিতত্ত্ব বিভাগে চলছে শৈবাল নিয়ে এই গবেষণা। শিক্ষার্থীদের কেউ শৈবাল দিয়ে আইসক্রিম তৈরি করছেন, কেউ তৈরি করছেন সাবান, কেউ বা মিষ্টি বা বিস্কুট।

পরীক্ষাগারের কোণে রাখা আছে রঙিন জিলাপি ও শৈবালনির্ভর ‘সি-উইড ফেস প্যাক’।

এগুলোর সবই প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি। পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষক তাঁদের নির্দেশনা ও পরামর্শ দিচ্ছেন।

দীর্ঘ গবেষণার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শৈবাল থেকে তৈরি করেছেন শুশি, নোরি শিট, সসেজ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ট্যাবলেট, সাবান ও উপটান। তাঁদের মতে, সি-উইড শুধু খাবার নয়, এতে আছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও।

শৈবাল থেকে মজাদার মিষ্টিশিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, ‘সি-উইড দিয়ে তৈরি আইসক্রিম খেতে একেবারে আলাদা স্বাদের। এতে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন আর মিনারেলস আছে, যা সাধারণ খাবারে পাওয়া যায় না। আর যদি উপকূলে বাণিজ্যিকভাবে শৈবালের চাষ শুরু হয়, তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে।’

গবেষকদলের নেতৃত্বে আছেন মৎস্য জীববিজ্ঞান ও কৌলিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রাজীব সরকার। তিনি বলেন, ‘আমি সি-উইডকে বলি সামুদ্রিক সবজি।

এতে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলের পরিমাণ এতটাই বেশি যে এটি ভবিষ্যতের বিকল্প খাদ্য হতে পারে। উপকূলরেখায় শৈবাল চাষ শুরু হলে কর্মসংস্থানও বাড়বে।’

গবেষক রাজীব সরকারের ভাষায়, বাংলাদেশের উপকূল শৈবাল চাষের জন্য আদর্শ। সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, গলাচিপা, মহিপুর—সবখানেই লবণাক্ত জল ও সূর্যালোকের প্রাচুর্য এই উদ্ভিদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। কুয়াকাটার চরগঙ্গামতি এলাকায় স্থানীয় ৬০ জন জেলেকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে তাঁদের দিয়ে শৈবাল চাষ করানো হচ্ছে।

সমুদ্র শুধু মাছের নয়, সবজিরও ভাণ্ডার : পটুয়াখালীর লোনা বাতাসে ভেসে আসছে এক নতুন আশার সুবাস। উপকূলের জোয়ার-ভাটার ছন্দে দুলছে যে শৈবাল, সেই সামুদ্রিক উদ্ভিদই এখন গবেষণাগারে ‘স্বপ্নের খাদ্য’ আর ‘সবুজ প্রসাধনী’তে রূপ নিচ্ছে। দীর্ঘ উপকূলরেখায় শৈবাল চাষের সুযোগ এখনো অনাবিষ্কৃত। অথচ বিশ্ববাজারে শৈবালের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।

খাদ্যপণ্য, ওষুধ ও প্রসাধনী—সব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে এই উদ্ভিদ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বজুড়ে সি-উইড এখন কোটি কোটি ডলারের শিল্প। শুধু জাপান ও কোরিয়ায়ই প্রতিবছর লাখ টন শৈবাল খাওয়া হয়। চীন, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে এটি খাদ্য ও ওষুধ শিল্পের প্রধান উপাদান।

সবুজ আশার আলো : গবেষকরা বলছেন, তাঁদের তৈরি পণ্য এরই মধ্যে স্থানীয়ভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও বাণিজ্যিক উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সামুদ্রিক শৈবাল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে স্যুপ। মানবদেহের জন্য উপকারী এই স্যুপ উদ্ভাবন ও প্যাকেটজাত করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মীর মোহাম্মদ আলী।

মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, কক্সবাজারের সমুদ্রের সি-উইড নিয়ে গবেষণা করে এই স্যুপ রেসিপি তৈরি করেছে তাঁর গবেষকদল। প্রতি ১২.৫ গ্রাম স্যুপে তাঁরা সি-উইড রেখেছেন ২.৫ গ্রাম। ফলে এই সাড়ে ১২ গ্রাম স্যুপে প্রোটিন থাকছে প্রায় ১০ গ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘এসএইউ সি-উইড স্যুপ’। এটি দ্রুত বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব হবে।

পবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই স্থানীয় উদ্যোক্তারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শৈবাল চাষ শুরু করুক। এতে উপকূলের মানুষ স্বনির্ভর হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের গবেষক বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রসাধনী প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছেন। তাদের সহযোগিতা পেলে এটি বাণিজ্যিকভাবে শুরু করা সম্ভব হবে।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ