
মেঘনার দ্বীপ জনপদ বরিশালের হিজলা উপজেলার গৌরবদী ইউনিয়ন। ওই এলাকাকে বলা হয় ‘ইলিশের খনি’! তবে বছরের পর বছর বেপরোয়া নিধনে ইলিশের খনি এখন প্রায় শূন্য। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাড়ে ১৫ বছর নদীর পানি ছাড়া সবকিছুর অঘোষিত মালিক ছিলেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম মিলন। ইলিশ আহরণে মৎস্য অধিদপ্তরের আইন থাকলেও ক্ষমতার জোরে সেখানে সবকিছু চলত তাঁর নিজস্ব নিয়মে। ইলিশ ব্যবসা করেই তিনি হয়েছেন বিত্তশালী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক পালাবদলের পর এখন মেঘনার এ অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদারসহ কয়েকজন নেতা। তারাও মিলনের দেখানো পথে হাঁটছেন।
চাঁদপুরের ষাটনল থেকে বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ পর্যন্ত মেঘনার দুই তীরে রয়েছে শত শত মাছঘাট। স্থানীয়ভাবে যিনি প্রভাবশালী, মাছঘাটের সংখ্যাও তার বেশি। প্রভাবশালীরা দাদন হিসেবে জেলেদের কাছে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। বিনিময়ে মাছ বিক্রির টাকার ১০ শতাংশ হারে কমিশন পান। প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ইলিশ নিধনে জেলেদের নেপথ্যে শক্তি এসব মাছঘাটের নিয়ন্ত্রকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নদীতীরে মাছঘাট নির্মাণ করে নিয়ন্ত্রণের প্রথা চালু হয়। এ ব্যবসায় সরকারের কোনো অনুমোদন লাগে না। জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন মাতুব্বর বলেন, এখন যে ইলিশ সংকট চলছে, এর জন্য দায়ী মৎস্য ব্যবসায়ীরা। তারাই প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বেপরোয়া জাটকা নিধন করছেন।
মেঘনায় যখন এ পরিস্থিতি তখন ইলিশ প্রজনন মৌসুম সামনে রেখে আগামীকাল শনিবার থেকে নদী ও সাগরে সব ধরনের মাছ আহরণের ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে।
ঘাটের হাতবদল
গত বছর ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে সব মাছঘাট বিএনপি নেতাদের দখলে যায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো তারাও অঞ্চলভিত্তিক ঘাট ভাগ করে নিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হিজলা-গৌরবদীসংলগ্ন মেঘনার অর্ধেক (উত্তর-পূর্ব দিক) গাফফার তালুকদার এবং বাকি অর্ধেকের একভাগ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বাযক খোকন দপ্তরি (দক্ষিণ দিক) এবং আরেক ভাগ অন্যরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। মেমানিয়া ইউনিয়ন-সংলগ্ন মেঘনার তিন ভাগের একভাগ গাফফার, এক ভাগ শ্রমিক দল সভাপতি শাহিন খান ও আরেক ভাগ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি সুজন সরদারের হাতে রয়েছে। হরিণাথপুর ইউনিয়ন-সংলগ্ন মেঘনার চার ভাগের এক ভাগ ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি খালেক মাঝি, এক ভাগ শরীয়তপুরে গোসাইহাট এলাকার বাদল গাজী আর বাকি দুই ভাগ ছাত্রদলের সুজনসহ অন্যদের কবজায় রয়েছে। ধুলখোলা ইউনিয়নঘেঁষা মেঘনার নিয়ন্ত্রণ করছেন ধুলখোলা বিএনপির আহ্বায়ক রাজ্জাক সরদার ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-আহ্বায়ক সগীর আহমেদ।
মেহেন্দীগঞ্জ-সংলগ্ন মেঘনা ভাগাভাগি করে নিয়ন্ত্রণ করেন হিজলার খোকন দপ্তরি, দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি আব্দুল হামিম নিটন চৌধুরী, উত্তর জেলা যুবদলের সদস্য মিল্টন চৌধুরী ও গোবিন্দপুর ইউনিয়ন যুবদল সভাপতি মিজান মাঝি।
ভোলার চরফ্যাসনঘেঁষা মেঘনা-তেঁতুলিয়ার একাংশের সামরাজ মাছঘাট আজিজ পাটোয়ারী ও চরমাদ্রাজের সাবেক চেয়ারম্যান শাহিন মালতিয়া; চর কুকরির মনুরা ঘাট এওয়াজপুর ইউনিয়নের আনোয়ার মাঝি ও আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের মালেক ফকির; চরকলমী বকশিঘাট ঘাটের সভাপতি কামরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আকবর পালোয়ান এবং ঢালচর মোহনার দুটি ঘাট ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি জাহাঙ্গীর মাতুব্বর, শাহে আলম ও বাবুল মাতুব্বর নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ভোলাসংলগ্ন তেঁতুলিয়ার আরেকপ্রান্ত পটুয়াখালীর বাউফল। উপজেলার শৌলাবগী এলাকা বিএনপিকর্মী সোহেল, ইব্রাহিম চন্দ্রদ্বীপ এলাকা বেল্লাল হোসেন, রুহুল আমিন, কেশবপুরের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহজাহান গাজীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এ ব্যাপারে হিজলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদার বলেন, আগে আমার অনেক মাছঘাট ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে ব্যবসা করতে পারিনি। এখন তিনটি ঘাট আছে। নতুন অনেকে ব্যবসায় নেমেছেন। জাটকা নিধনে তারা জড়িত থাকতে পারে। আমি এসব পছন্দ করি না।
মেহেন্দীগঞ্জ গোবিন্দপুর ইউনিয়ন যুবদল সভাপতি মিজান মাঝি জাটনা নিধনের সঙ্গে সম্পৃক্তার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মেঘনায় জাটকা পাওয়া যায় না। তাহলে কীভাবে জাটকা শিকার করব। মোকামে বিক্রি হওয়া হাজার হাজার মণ জাটকা কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পদ্মাসহ ছোট ছোট নদীতে এসব ধরা হয়। তিনি জানান, আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে তাদের সাত থেকে আটটি মাছঘাট আছে।
তবে হিজলা উপজেলা শ্রমিক দল সভাপতি শাহিন খান স্বীকার করেন, নির্বিচারে জাটকা নিধন করার কারণে মেঘনায় এখন ইলিশ নেই। তবে এর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম মিলনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি।
নির্বিচারে নিধন
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশের যে সংকট চলছে, এর অন্যতম কারণ প্রজননের সময় মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে নির্বিচারে জাটকা ও রেণু নিধন। নিষিদ্ধ কারেন্ট, বেহুন্দি, বাঁধা, খুঁটিসহ বিভিন্ন জাল ব্যবহার করেন জেলেরা। মোহনায় সামুদ্রিক বৈরাগী মাছ ধরতে শত শত কেজি ইলিশের পোনা মেরে ফেলা হয়। চিংড়ি ধরতে গিয়ে জেলেরা অন্য মাছের হাজার হাজার রেণু ধ্বংস করছে।
জেলেদের এসব স্বেচ্ছাচারিতা ঠেকাতে প্রজনন মৌসুমে (আশ্বিন মাস) নদী-সাগরে ২২ দিনের জন্য সব মাছ আহরণ এবং মার্চ-এপ্রিলে নদীতে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন ৮ মাস জাটকা নিধন নিষিদ্ধ করে মৎস্য অধিদপ্তর। জেলেদের এসব নিয়ম মানাতে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হতে হয় গলদর্ঘম। মাছঘাট নিয়ন্ত্রণকারীদের ছত্রছায়ায় জেলেরা এতটাই বেপরোয়া যে, অভিযানে গিয়ে হামলার মুখে কোস্ট গার্ড বহর ফিরে আসারও নজির রয়েছে। গত মার্চ-এপ্রিলে নিষেধাজ্ঞার সময় মেঘনায় অভিযানে গিয়ে তিনবার হামলার মুখে পড়েন ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ।
মৎস্য অধিদপ্তরের জাটকা জব্দের হিসাবেই উঠে এসেছে মেঘনায় দিন দিন জাটকা কী হারে কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ মাসে জাটকা জব্দ হয়েছিল ১৪৬ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০৮ টন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১ টন এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৭ টন জব্দ হয়।
তবে অভিযোগ রয়েছে, অভিযানে নিধন জাটকার সামান্য পরিমাণ জব্দ দেখানো হয়। নিষিদ্ধ সময়ে পাইকারি মোকামে শত শত মণ জাটকা বিক্রি হতে দেখা যায়। ২ থেকে ৩ ইঞ্চি সাইজের ইলিশ চাপিলা নামে বিক্রি হয়। ২০০ টাকায় এক কেজিতে পাওয়া যায় কমপক্ষে ৪০ পিস।
মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ সমকালকে বলেন, মা ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র চাঁদপুরে ষাটনল থেকে বরিশালের হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ ঘেঁষা মেঘনা। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুরের রায়পুর-সংলগ্ন মেঘনা ও শরীয়তপুরে জাজিরা ও গোসাইহাট-সংলগ্ন পদ্মায় বিচরণ রয়েছে। মেঘনার ইলিশ রক্ষা না হলে কোথাও ইলিশ থাকবে না।
তিনি জানান, কাল থেকে ২২ দিনের জন্য সব ধরনের মাছ আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। এবার নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের ঠেকাতে প্রতিটি পয়েন্টে স্পিডবোট রাখা হবে। মাছঘাটে অপকর্মের নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো স্থানীয় প্রশাসন দেখবে, আমার দেখার দায়িত্ব শুধু নদী।