ঢাকা   মঙ্গলবার
১৪ অক্টোবর ২০২৫
২৮ আশ্বিন ১৪৩২, ২১ রবিউস সানি ১৪৪৭

উত্তর জনপদের মাছ বৈরালি

ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ

প্রকাশিত: ১০:১০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

উত্তর জনপদের মাছ বৈরালি

অতিমারি করোনার সময় দাপ্তরিক কাজে একবার উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর গিয়ে স্থানীয় একটি অতিথি ভবনে অবস্থান করছিলাম। এটি ছিল তিস্তা নদীর কাছেই। সন্ধ্যায় তিস্তা নদী দেখতে বের হলাম। নদীর কিনারায় তখন লোকজন চটকা জাল দিয়ে মাছ ধরছে।

কৌতূহলবশত কাছে গিয়ে দেখি জালে ১০-১২ গ্রাম ওজনের ছোট ছোট মাছ ধরা পড়ছে। রুপালি রঙের চকচকে এই মাছের দেহে ছোট ছোট আঁইশ, পৃষ্ঠদেশ বরাবর সমান্তরালে লম্বালম্বিভাবে ফোঁটা ফোঁটা কালো দাগ এবং আবার কোনোটির পেটের নিচে হলুদ দাগ আছে। দেখে বোঝা গেল, এগুলো বৈরালি মাছ। বৈরালি ধরার দৃশ্য সরাসরি এই প্রথম অবলোকন করলাম।

কথা হলো জেলেদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, বৈরালি মাছ দিনের বেলায় গভীর পানিতে থাকে; বিকেল হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে নদীর কিনারায় চলে আসে এবং ভোর পর্যন্ত পানির ওপরে চলাফেরা করে। তখনই মূলত বৈরালি মাছ ধরা পড়ে। শিকার করার পরপরই বৈরালি দ্রুত মারা যায়।

পাহাড়ি ঝরনা ধারার সঙ্গে সংযুক্ত নদী এবং অগভীর ও স্বচ্ছ পানিতে এরা বসবাস করে। ঘোলা পানিতে বৈরালি মাছ থাকে না। ইলিশের ন্যায় বৈরালির রুপালি চকচকে রং এবং ঝাঁকে ঝাঁকে চলাফেরা করে বিধায় বৈরালি মাছকে ‘তিস্তার ইলিশ’ নামেও ডাকা হয়।

বৈরালি Cyprinidae পরিবারভুক্ত অণুপুষ্টিসমৃদ্ধ মিঠা পানির একটি ছোট মাছ। বাংলাদেশে Barilius barila, Barilius bendelissis, Barilius barna, Barilius tileo, Barilius vagra এবং Barilius shacra নামে বৈরালি মাছের পাঁচটি প্রজাতি রয়েছে।

বৈরালি মাছ বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় একটি মাছ। তাজা অবস্থায় রান্না করে খেলে এ মাছ খুবই সুস্বাদু। অঞ্চলভেদে বৈরালি মাছকে বারালি, কোকসা ও শৈরালি নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমার পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি রয়েছে। ভারতের কোচবিহারে বৈরালি মাছের ব্যাপক চাহিদা ও কদর রয়েছে। রসনা তৃপ্তির জন্য বৈরালিকে ঘিরে আয়োজন করা হয় বার্ষিক উৎসব। উৎসবে ‘দই বৈরালি’, ‘সরষে বৈরালি’ ‘ভাপা বৈরালি’ ইত্যাদি নানা পদের খাদ্য পরিবেশন করা হয়।
দেশের উত্তর জনপদ ছাড়াও ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে একসময় এ মাছটি পাওয়া যেত। বর্তমানে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা, ধরলা, চিকলি, ঘাঘট এবং ব্রহ্মপুত্র নদে এ মাছ পাওয়া যায়। দিনাজপুর অঞ্চলের আত্রাই নদীতে কদাচিত দেখা মেলে। একসময় এই মাছটি জামালপুরের মাদারগঞ্জ এলাকার যমুনা নদীতেও পাওয়া যেত। এখন আর পাওয়া যায় না। জামালপুর এলাকাতে এ মাছটিকে শৈরালি নামে ডাকা হতো। এই মাছটির প্রধান উৎস হচ্ছে আন্তঃদেশীয় নদী তিস্তা। তিস্তার উজানে যখন পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, তখন এ মাছ বেশি ধরা পড়ে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রাপ্যতা হ্রাস পায়। তিস্তার উজানে বাঁধ দেওয়ার ফলে বৈরালির বাসস্থান ও প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় এবং নির্বিচারে পোনা নিধনের কারণে দিন দিন নদ-নদীতে এ মাছের প্রাচুর্যতা হ্রাস পেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বৈরালি মাছকে বিপন্নের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো Barilius barila প্রজাতির কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফলতা অর্জন করে। পিজি ও ওভাপ্রিম হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করে বৈরালি মাছের কৃত্রিম প্রজনন করানো হয়। এই প্রজাতির মাছের ইংরেজি নাম Barred baril এবং এর দেহ সরু ও পার্শ্বীয়ভাবে সামান্য চাপা। পরিপক্ব মাছের মাথায় কয়েক সারি ছিদ্র আছে। মুখের চঞ্চুতে দুই জোড়া স্পর্শি আছে। ওপরের চোয়াল পেছনের দিকে চোখের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। কানকো সোনালি রঙের এবং পাখনা দেখতে গোলাপি রঙের। এ মাছের ডিপ্লোয়েড ক্রমোজমের সংখ্যা ৫০।

বৈরালি মাছ আমাদের দেশে দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ১০ সেন্টিমিটার এবং ওজনে ২১ গ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এ মাছে ছোট ছোট অনেক কাঁটা থাকলেও কাঁটা নরম। বৈরালি মাছের প্রজননকাল নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। একই বয়সের প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের চেয়ে আকারে বড় হয়। পুরুষ মাছের তুলনায় স্ত্রী মাছের দেহ বেশি গভীর। একটি পরিপক্ব মা মাছ থেকে বয়স ও ওজনভেদে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০টি ডিম পাওয়া যায়। পরিপক্ব ডিমের রং গাঢ় হলুদ হয়।

বৈরালি সর্বভুক শ্রেণির মাছ। প্ল্যাংকটন, পোকামাকড়ের শুককীট, ক্রাস্টাসিয়ানস ইত্যাদি এদের প্রধান খাদ্য। ছোট ও মৌসুমি পুকুর এবং খরাপ্রবণ এলাকায় বৈরালি মাছ সহজেই চাষ উপযোগী। পোনা মজুদের পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে মাছ বিক্রয়যোগ্য হয়ে ওঠে। রুই জাতীয় মাছের সঙ্গে বৈরালির মিশ্র চাষ অধিক লাভজনক। আকারভেদে বৈরালি মাছ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বিলুপ্তির হাত থেকে সুরক্ষা ও ভোক্তাদের পাতে সহজলভ্য করার জন্য বৈরালি মাছের চাষ দেশব্যাপী উপযুক্ত এলাকায় সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।

লেখক : মৎস্য বিশেষজ্ঞ (ইমেইল : yahiamahmud@yahoo.com)