ঢাকা   মঙ্গলবার
১৪ অক্টোবর ২০২৫
২৮ আশ্বিন ১৪৩২, ২১ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট: অর্ধ শতাব্দীর গৌরব ও অর্জন

জীবন কষ্ণ বিশ্বাস পিএইডি

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ১ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট: অর্ধ শতাব্দীর গৌরব ও অর্জন

আজ, ১ অক্টোবর ২০২৫, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) তার গৌরবময় যাত্রার ৫৬তম বছরে পদার্পণ করল। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে যে বাংলাদেশের প্রধান সংকট ছিল বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের যোগান, সেই দেশ আজ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একসময় যে দেশকে ব্যঙ্গ করে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হয়েছিল, কালের পরিক্রমায় সেই বাংলাদেশ আজ খাদ্য নিরাপত্তায় বিশ্বের বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই অবিশ্বাস্য অর্জনের পেছনের মূল চালিকাশক্তি হলো বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং এর অগণিত বিজ্ঞানী, গবেষক, কর্মকর্তা ও কৃষকদের নিরলস পরিশ্রম। ধান গবেষণার এই দীর্ঘ পথচলাকে মূলত পাঁচটি পর্বে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।

আদি পর্যায় (১৯১০-১৯৩৯): গবেষণার বীজ বপন বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ধান গবেষণার সূচনা হয় ব্রিটিশ আমলে। ড. জি.পি. হেক্টর ও ড. হেদায়েতুল্লাহর মতো বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে সীমিত পরিসরে এর যাত্রা শুরু হয়। তখনকার মূল লক্ষ্য ছিল দেশীয় ধানের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, বিশুদ্ধ সারি বাছাইকরণ এবং ধানের বাস্তুসংস্থান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। এই সময়েই কটকতারা, ধারিয়ালের মতো আউশ এবং ঝিঙ্গাশাইল, লতিশাইল, নাইজারশাইলের মতো জনপ্রিয় আমন ধানের জাতগুলো কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৩৪ সালে হবিগঞ্জে উপমহাদেশের প্রথম জলি আমন ধান গবেষণাগার স্থাপন ছিল এ পর্বের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

প্রাক-প্রস্তুতি পর্যায় (১৯৪০-১৯৫৯): প্রতিকূলতা ও পুনর্গঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, দেশভাগসহ নানা ঐতিহাসিক সংকটের কারণে এ সময়ে গবেষণা কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। তবে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে ড. এ. আলীম ও ড. এম. ও. গনির মতো দূরদর্শী ব্যক্তিদের হাত ধরে ধান গবেষণাকে পুনর্গঠিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। তাঁদের প্রণীত ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী আধুনিক গবেষণার পথ সুগম হয়। ইন্দ্রশাইল, দুধসর, বাদশাভোগের মতো উন্নত জাতগুলো এ সময়েরই ফসল।

প্রস্তুতি পর্যায় (১৯৬০-১৯৬৯): উফশী বিপ্লবের সূচনা এই দশকটি ছিল বাংলাদেশের ধান গবেষণার মোড় ঘোরানোর সময়। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (IRRI) প্রতিষ্ঠার পর এর সঙ্গে সমন্বয় করে ১৯৬৫ সালে ড. এ. আলীমের উদ্যোগে গৃহীত হয় "East Pakistan Accelerated Rice Research (EPARR)" শীর্ষক প্রকল্প। এর নেতৃত্বে ছিলেন ধান গবেষণার আরেক দিকপাল ড. শাহ মোহাম্মদ হাছানুজ্জামান। এই প্রকল্পের অধীনেই ফিলিপাইন থেকে আনা উচ্চ ফলনশীল (উফশী) কৌলিক সারি নিয়ে কাজ শুরু হয়। ১৯৬৭-৬৮ সালে আইআর-৮ (IR8) অবমুক্ত করা হয়, যা ছিল এক настоящая বিপ্লব। প্রচলিত জাতের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি ফলন দিয়ে এটি সারা দেশে ‘ইরি ধান’ নামে পরিচিতি পায় এবং খাদ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে আশার আলো দেখায়।

উফশী পর্যায় (১৯৭০-২০০৯): ব্রির জন্ম ও সবুজ বিপ্লব স্বাধীনতার ঊষালগ্নে, ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর, EPARR প্রকল্পটি পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যা স্বাধীনতা লাভের পর ‘বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)’ নামে পরিচিতি পায়। ১৯৭৩ সালে সংসদীয় আইনের মাধ্যমে এটিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হয়। এই পর্যায়টি ছিল ব্রির স্বর্ণযুগ।

এ সময় ব্রি একের পর এক যুগান্তকারী জাত উদ্ভাবন করে, যা দেশের সবুজ বিপ্লবকে তরান্বিত করে। এর মধ্যে বিআর৩ (বিপ্লব) জাতটি ছিল অন্যতম, যা আউশ, আমন ও বোরো—তিন মৌসুমেই চাষযোগ্য হওয়ায় ধানের উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে আসে। এছাড়াও বিআর১১, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯-এর মতো মেগা ভ্যারাইটিগুলো দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। ফলন বৃদ্ধিই ছিল এ পর্যায়ের মূল লক্ষ্য, তবে এর পাশাপাশি প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল জাত উদ্ভাবনের কাজও চলতে থাকে।

উফশী-উত্তর পর্যায় (২০১০-বর্তমান): টেকসই নিরাপত্তার পথে যাত্রা বর্তমানে ব্রির গবেষণার লক্ষ্য শুধু ফলন বৃদ্ধি নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা করে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ পর্যায়ে লবণাক্ততা, খরা, ও জলমগ্নতা সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। কম সময়ে অধিক ফলন, জিঙ্ক-সমৃদ্ধ ধান, ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুপার রাইস উদ্ভাবনের মতো কাজগুলো পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ‘ট্রান্সফর্মিং রাইস ব্রিডিং’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অর্ধেক সময়ে জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে, যা দেশের কৃষিতে আরেকটি বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

আজ বাংলাদেশ চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর সিংহভাগ কৃতিত্ব বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের। পাশাপাশি বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এবং বেসরকারি খাতের অবদানও অনস্বীকার্য। হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ আজ উপচে পড়া খাবারের ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। ব্রির নিরন্তর গবেষণা ও উদ্ভাবনই এই অসামান্য সফলতার মূল ভিত্তি, যা আগামী দিনেও দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট।