বিস্তির্ণ মাঠ জুড়ে বাতাসে দোল খাওয়া সরিষা ফুল যেন প্রকৃতিতে যোগ করেছে অনন্য এক সৌন্দর্য। হেমন্তের শেষে আর পৌষের শুরুতে যখন শীতের সকাল নেমে আসে, তখন বাংলার প্রকৃতি এক অপার্থিব রূপ ধারণ করে। রোপা আমন পরবর্তী বোরো ধানের ক্ষেতের নরম মাটি যখন মিষ্টি রোদ পোহায়, ঠিক তখনি ঝিরি ঝিরি বাতাসে দোল খায় হলুদ সর্ষে ফুল। সেই দিগন্তজোড়া খোলা প্রান্তরে তাকালে মনে হয়, যেন জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় চরিত্র পকেটবিহীন হিমুর হলদে পাঞ্জাবি কেউ যেন পরম যত্নে রোদে শুকাতে বিছিয়ে দিয়েছে। সেই হলুদের গালিচায় চঞ্চল প্রজাপতির মেলা বসে, আর মৌমাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে পরম মমতায় মধু আহরণে। কুয়াশার পাতলা চাদর ভেদ করে যখন সূর্যের প্রথম আলোর ঝলকানি মিশে যায় এই হলুদের সমারোহে, তখন মনে হয় যেন মাটি থেকে সোনা ঠিকরে বেরোচ্ছে।
জেলার পরিশ্রমী কৃষকেরা আগাম রোপা আমনের ফসল ঘরে তোলার পর এক মুহূর্তের জন্যও বসে থাকেন না। আগাম জাতের ধান চাষ করার ফলে ধানি ফসলি জমি বেশ কয়েকমাস পতিত অবস্থায় থাকে। আগেকার দিনে এই জমিগুলো অবহেলায় পড়ে থাকত, কিন্তু এখন আর ওই সব পতিত জমি কৃষকেরা ফেলে রাখেন না। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পতিত জমিতে এখন অতিরিক্ত একটি 'বোনাস' ফসল হিসেবে সরিষার আবাদ করছেন অনেক কৃষক। নেত্রকোণা জেলায় এবছরও সরিষার অধিক ফলনে কৃষকের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক।
জেলায় এবছর সরিষার আবাদের জোয়ার এসেছে। গত বছরের তুলনায় আবাদের পরিমাণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এবছর জেলায় মোট ১৪ হাজার ৩২ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে, যা গত বছরের ১৩ হাজার ৫০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে।
সরেজমিনে স্থানীয় কৃষকদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, বোরো ধান চাষের আগের এই সময়টুকু সরিষা ফলানোর সময়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং প্রযুক্তির ছোঁয়া পেয়ে তারা এই সুযোগটি হাতছাড়া করছেন না। অতীতে এ অঞ্চলে সরিষার ব্যাপক আবাদ হলেও মাঝখানে তা অনেকটা কমে এসেছিল। তবে বর্তমানে কৃষি বিভাগের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও সার্বিক সহায়তায় কৃষকেরা আবারো সেই পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে যাচ্ছেন।
সদর উপজেলার পশ্চিম উলুয়াটি গ্রামের আব্দুল মন্নাফ খান একজন বিচক্ষণ কৃষক, তার চোখেমুখে এখন নতুন ফসল উৎপাদনের স্বপ্ন। তিনি জানান, রোপা আমন ধান কাটার পর বোরো ধান চাষের আগ পর্যন্ত জমিগুলো অনেকটা সময় অলস পড়ে থাকে। তাই আমি পরিকল্পনা করে আগাম জাতের রোপা আমন চাষ করি, যাতে আগেভাগেই ফসল ঘরে তুলে সরিষার আবাদ শুরু করতে পারি।
তিনি বলেন, কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময়েই আমি ক্ষেত প্রস্তুত করে সরিষার বীজ ছিটিয়ে দেই। ফসল ঘরে তুলতে মাত্র তিন মাস সময় লাগে। গত বছর মাত্র ৪ কাঠা জমিতে পরীক্ষামূলক আবাদ করে ৫ মণ সরিষা পেয়েছিলাম। সেই সফলতায় এবার ৫ কাঠা জমিতে আবাদ করেছি, ইনশাআল্লাহ এবারও আশানুরূপ ফলন পাব বলে আমার বিশ্বাস।"
সরিষা চাষে যেমন আশা আছে, তেমনি খরচের দিকটিও কৃষকদের মাথায় রাখতে হয়। জমি প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে বীজ, সার এবং ফসল কাটা পর্যন্ত আনুষঙ্গিক অনেক খরচ রয়েছে। তবে বর্তমান বাজারে ভালো মানের সরিষার যে বিপুল চাহিদা, তাতে কৃষকেরা ভালো-ই লাভের মুখ দেখছেন। আগে যেমন হাটে-বাজারে সরিষা কেনার নির্দিষ্ট আড়ত ছিল, এখন আর তেমনটি নেই; কৃষকেরা সরাসরি বিভিন্ন দোকানে প্রতি মণ সরিষা ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকায় বিক্রি করতে পারছেন। আবার অনেকে আছেন যারা বাণিজ্যিক লাভের চেয়ে নিজের পরিবারের স্বাস্থ্যকর তেলের চাহিদাকেই বড় করে দেখেন। নিজেদের আবাদ করা সরিষা ভাঙিয়ে সেই ঘানি টানা তেল দিয়ে তারা সারা বছরের প্রয়োজন মেটান।
সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের লাইট গ্রামের কৃষক রফিক মিয়া নদীর চরের জমিতে প্রতিবছরই সরিষার আবাদ করে থাকেন।
তিনি জানান, বাপ-দাদার আমলে আমরা নদীর চরে আর উজানের জমিতে ধান ছাড়াও সরিষা, ভুট্টা, বাদাম আর তিলের আবাদ করতাম। এখন ধান আবাদের পাশাপাশি সরিষা আবাদ করি। আমাদের এলাকার সব কৃষক ভাইয়েরা যদি একই সময়ে একযোগে সরিষা আবাদ করত, তাহলে অতীতের সেই সোনালী দিনগুলো আবার ও ফিরে আসত।
আসল বাস্তবতা হলো, উজানের বেশিরভাগ জমিতে বছরে দুবার ধান আবাদের ফলে ফসলের বৈচিত্র্য কিছুটা কমেছে।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি প্রশিক্ষণ পেলে তারা একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল ফলাতে সক্ষম। কৃষি বিভাগের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও নিয়মিত তদারকি এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ) মুকশেদুল হক এ বিষয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। তিনি বাসসকে বলেন, "আমন এবং বোরো ধানের মধ্যবর্তী এ দুই-আড়াই মাস সময়টা আমাদের কৃষির জন্য এক বিশাল সম্ভাবনা। এ সময়ে জমি পতিত না রেখে সরিষা চাষের জন্য আমরা কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এবছর ১৪ হাজার ৩২ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করেছে। আমরা সরকারি প্রণোদনার আওতায় জেলায় ১১ হাজার কৃষককে বীজ ও সার দিয়েছি। এছাড়া আরও ৩ হাজার ৫০০ কৃষককে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা করা হচ্ছে।"
তিনি আরও জানান, "কৃষকদের স্বল্প মেয়াদি আমন চাষে উদ্বুদ্ধ করার ফলে সরিষার জন্য প্রয়োজনীয় সময় বের করা সম্ভব হচ্ছে। উঠান বৈঠক ও মাঠ দিবসের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে আধুনিক জাত যেমন—বারী সরিষা-১৪, ১৭ এবং বিনা-৯, ১১-এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে জেলার সদর, মদন ও পূর্বধলা উপজেলায় সরিষার এই নীরব বিপ্লব এখন দৃশ্যমান।"























