কৃষক মাঠে নেমেছিলেন স্বপ্ন নিয়ে। উচ্চ মূল্যে সার, বীজ কিনে ফলিয়েছিলেন আলু। ফলনও হয়েছে ভালো। কিন্তু সেই আলু এখন কৃষকের ঘাড়ে বোঝা। বাজারে দাম নেই; হিমাগারে পড়ে আছে স্বপ্নের ফসল। সেই ফসল তুলতে গেলেই পকেট থেকে গুনতে হচ্ছে আরও টাকা। লাভের আশায় যে আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল, তাই এখন বেদনার কারণ। নতুন আলু বাজারে আসতেই পুরোনো আলুর দাম আরও পড়ে গেছে। কোথাও কোথাও পাঁচ-ছয় টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে আলুর দর এতটাই নেমেছে, বিক্রি করেও হিমাগারের ভাড়া মেটানো যাচ্ছে না। উল্টো সংরক্ষিত আলু তুলতে গেলে বস্তাপ্রতি পকেট থেকে গুনতে হবে আরও ২০ টাকা। এই লোকসানের হিসাব কষেই হিমাগার থেকে আলু তুলতে যাচ্ছেন না চাষি ও ব্যবসায়ীরা। ফলে একের পর এক নোটিশ দিয়েও সাড়া না পেয়ে এলাকায় মাইকিং করে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আলু তুলে নেওয়ার সময় বেঁধে দেয় হিমাগার কর্তৃপক্ষ। তাতেও আলু নিতে যাননি চাষিরা।
হিমাগার কর্তৃপক্ষ জানায়, আর কয়েক দিনের মধ্যে আলু না নিলে সংরক্ষণের শীতলযন্ত্র বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরে ওই আলুর দায় তারা নেবে না। তবে সংরক্ষণ ভাড়া আদায় করা হবে। বর্তমান বাজারদরে আলু বিক্রি করে সেই ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব না হওয়ায় চাষি ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারমুখী হচ্ছেন না। এতে কৃষকরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন, অন্যদিকে বিপাকে পড়েছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ।
এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয় কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনকে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডিসেম্বরজুড়ে আলু সংরক্ষণের অনুরোধ জানায়। এর মধ্যেই আলু তুলে নিতে মাইকিং শুরু হওয়ায় চাষিদের মধ্যে ক্ষোভ ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
এদিকে, বাজারে সরবরাহ বাড়তে থাকায় মৌসুমি সবজির দাম কমেছে। নতুন আলুর সরবরাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো আলুর চাহিদা তলানিতে নেমেছে। গতকাল বাজারে পুরোনো আলু কেজিপ্রতি ১১ থেকে ১৪ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। ব্যবসায়ীরা জানান, গত ২০ থেকে ২৫ দিনে পুরোনো আলুর দাম কেজিতে কমেছে প্রায় আট টাকা। তাদের ভাষায়, ‘নতুন আলু যেন পুরোনো আলুর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।’
উৎপাদন খরচ, পরিবহন ব্যয় ও হিমাগার ভাড়া মিলিয়ে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। লাভের আশায় মজুত রাখা আলু এখন অনেকের কাছে ‘গলার কাঁটা’। উৎপাদন খরচের চাপ সামলাতে না পেরে কোথাও কোথাও আলু খাওয়ানো হচ্ছে গরু-ছাগলকে।
হিমাগারে আলুর পাহাড়
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে প্রায় চার লাখ ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ টনের বেশি। অথচ দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ টন। বীজের জন্য আরও ৮-১০ লাখ টনের প্রয়োজন হয়। হিসাব অনুযায়ী, গত মৌসুমে অন্তত ২৫-৩০ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থেকে যায়। এই আলুই হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানায়, দেশে ৩৮৪ হিমাগারে প্রায় ৩৩ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। গত মৌসুমে এর প্রায় পুরোটাই ভর্তি ছিল। এর মধ্যে বীজ আলু রয়েছে ১০ লাখ টনের বেশি। এখন এই বিপুল পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ার মতো দাম নেই। এ পরিস্থিতিতে আলু বিক্রি করেও হিমাগারের ভাড়া শোধ হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে আলু তুলতে গেলে বস্তাপ্রতি আরও ২০ টাকা করে পকেট থেকে দিতে হচ্ছে। তাই হিমাগারে যাচ্ছেন না কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
জয়পুরহাট, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় হিমাগার কর্তৃপক্ষ আলু তুলে নেওয়ার জন্য নোটিশ দিয়েছে। কোথাও ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আলু না তুললে সংরক্ষণের শীতলযন্ত্র বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণাও এসেছে।
জয়পুরহাটের কালাইয়ের বেগুনগ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘২৫০ বস্তা আলু হিমাগারে রেখেছি। এখন বিক্রি করলে দাম তো পাবই না, উল্টো বস্তাপ্রতি ২০ টাকা দিতে হবে। তাই আলু তুলতে যাইনি।’
কালাইয়ের একটি হিমাগারের সহকারী ব্যবস্থাপক এনামুল হক বলেন, গড়ে এখনও ২০ শতাংশ আলু মজুত আছে, চাষি আসছেন না। শেষ পর্যন্ত যন্ত্র বন্ধ করে আলু বাইরে বের করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
নতুন আলুর কারণে আরও বিপদ
সংকটের মধ্যেই বাজারে নতুন আলুর সরবরাহ শুরু হয়েছে। ফলে পুরোনো আলুর চাহিদা আরও কমেছে। কোথাও পুরোনো আলু বিক্রি হচ্ছে পাঁচ-ছয় টাকা কেজিতে, নতুন আলু ২০-২১ টাকায়। এতে আগাম জাতের আলুচাষিরাও লোকসানে পড়েছেন।
চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনার যে ঘোষণা দিয়েছিল, তা এখনও কাগজে-কলমে কার্যকর হয়নি। প্রজ্ঞাপন না থাকায় হিমাগার পর্যায়ে কেউ ওই দামে আলু কিনছে না। ফলে ঘোষণার প্রভাব পড়েনি বাজারে।
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, হিমাগারে থাকা চার থেকে পাঁচ লাখ টন আলু নিয়ে আমরা বিপদে আছি। নভেম্বরের মধ্যে আলু নেওয়ার কথা থাকলেও অনেকে নেননি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, সাধারণত কৃষক ও ব্যবসায়ীরা নভেম্বরের মধ্যে হিমাগার থেকে আলু বের করে থাকেন। তবে ১৮ নভেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে হিমাগার মালিকদের অনুরোধ করা হয়, যেন ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা আলু সংরক্ষণ করে। এতে হিমাগার মালিকরা সম্মতি দেন।
সবজি ছাড়িয়ে আলুর বহুমুখী ব্যবহার বাড়েনি
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে উৎপাদিত আলুর মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ সবজির বাইরে অন্য কাজে ব্যবহার হয়। অথচ উন্নত দেশগুলোতে আলু এখন একটি বড় শিল্পপণ্য।
চায়নিজ একাডেমি অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসের গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের মোট উৎপাদিত আলুর ৬৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করে। বড় অংশ ব্যবহৃত হয় হিমায়িত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ফাস্টফুড শিল্পে। কানাডায় এ হার ৬৮ শতাংশ, জার্মানিতে ৭০-৮০ শতাংশ, বেলজিয়ামে ৮০ শতাংশ। চীন উৎপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ আলু প্রক্রিয়াজাত করে, আর ভারতে এ হার ৭ শতাংশ।
দেশের বাজারে চিপসসহ নানা পণ্য বাজারজাত করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, আলুর প্রসেসড খাবারের বাজার বড় হচ্ছে। তবে এই খাতে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সব জাতের আলু দিয়ে সব ধরনের প্রসেসড খাবার বানানো যায় না। সঠিক জাত নির্বাচন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বড় সমস্যা। কৃষক পর্যায়ে অনেক সময় সংরক্ষণ সঠিকভাবে না হওয়ায় আলুর গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোশাররফ হোসেন মোল্লা বলেন, বাংলাদেশে আলুতে পানির পরিমাণ বেশি, ড্রাই-ম্যাটার কম। ফলে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন বহুমুখীকরণ এখনও ব্যয়সাপেক্ষ। এটিকে লাভজনক করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাংলাদেশে বহুমাত্রিক ব্যবহার নেই বলেই উদ্বৃত্ত আলু নিয়ে প্রতি বছর হাহাকার তৈরি হয়। মোট উৎপাদনের ১ শতাংশেরও কম আলু রপ্তানি হয়। বিশ্বে আলুর স্টার্চ ও ফ্লেকভিত্তিক পণ্যের বাণিজ্য প্রতি বছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই খাতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার। কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে– কোন জাত কোন কাজে ব্যবহার উপযোগী, কীভাবে সংরক্ষণ করলে গুণগত মান বজায় থাকে।























