
গতকাল শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে বৃক্ষমেলায় মেসার্স বাশিদা নার্সারির স্টলে হুইলচেয়ারে বসে দরদামে ব্যস্ত ষাটোর্ধ্ব আফসানা বেগম। তিনি এসেছেন নাতি-নাতনিসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বৃক্ষমেলা দেখতে এবং গাছের চারা কিনতে। ফল ও ফুল মিলিয়ে ১১ হাজার ৩০০ টাকার চারা কিনেছেন।
আদাবরে নিজের বাড়িতে লাগাবেন চারাগুলো।
গতকাল সরকারি ছুটির দিন থাকায় অন্যান্য দিনের চেয়ে বৃক্ষমেলায় ভিড় ছিল অনেক বেশি। আফসানা বেগমের মতো অনেকেই মেলায় এসেছিল সপরিবার। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও দল বেঁধে মেলা দেখছিল, চিনছিল গাছ।
কেউ কেউ ছবি তুলছিল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে।
সবুজে ঘেরা ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয়ে গত ২৫ জুন জাতীয় বৃক্ষমেলা ২০২৫ শুরু হয়। ‘পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি’—এই স্লোগানে বন অধিদপ্তর আয়োজিত এই মেলা চলবে ২৪ জুলাই পর্যন্ত। বৃক্ষমেলায় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে বৃক্ষপ্রেমীদের বিচরণ।
জানা গেছে, এবার মেলায় বিদেশি ফলের গাছের চাহিদা বেশি।
পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে এখন ফল, ফুল, শোভাবর্ধক ও ঔষধি গাছের সমাহার। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে আসে প্রশান্তি। গাছের ডালে ডালে ফুটেছে দেশি-বিদেশি নানা রঙের ফুল।
ফলগাছের মধ্যে রয়েছে আম, আমলকী, জাম, জামরুল, আতা, পেয়ারা, কামরাঙা, করমচা, বেল, কদবেল, লঙ্গান, রাম্বুটান, ডুরিয়ান, কাঁঠাল, জাম্বুরা, সফেদা, লিচু, আনার, কলা, চেরি ফল, কুল, জামির, স্ট্রবেরি, নাশপাতি, লটকন, কাঠলিচু, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি। অন্তত ২০০ প্রজাতির বাঁশ আছে। রয়েছে ক্যাকটাস, বনসাই, ইনডোর প্ল্যান্টস ও খেজুরগাছ।
উত্তরা থেকে আসা কলেজছাত্ররা দল বেঁধে মেলার গোলচত্বরে ছবি তুলছিল। তাদের একজন সৌরভ শুভ বলে, ‘গাছ ভালো লাগে, তাই প্রতিবছর বৃক্ষমেলায় আসি। আজ বন্ধুরা মিলে ঘুরতে এসেছি। পরে গাছের চারা কেনার জন্য আব্বু-আম্মুকে নিয়ে আসব। আমাদের অনেক বড় ছাদবাগান রয়েছে। আমার বাসার রুমে ও বারান্দায় গাছ আছে। সেখানে আরো গাছ রাখব। তাই দেখতে এসেছি।’
আষাঢ়ের তপ্ত দুপুরে স্টল ঘুরে দেখান এবং ফল-ফুল সম্পর্কে জানান মেসার্স বাশিদা নার্সারির বিক্রয়কর্মী আমিনুল ইসলাম। তিনি জানান, এবারের মেলায় বিদেশি ফলের গাছের চাহিদা বেশি। অনেকেই ছোট ছোট গাছে ফল ধরে থাকা টব কিনছে। শহরের বাসার ছাদ ও বারান্দায় রাখতে পারবে। অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ফল এখন দেশে চাষ হচ্ছে। তিনি আরো জানান, তাঁদের স্টলে নানা প্রজাতির ফল, ফুল ও ঔষধি গাছ আছে। এর মধ্যে ‘রুবি লঙ্গান’ ফলগাছের দাম হাঁকা হয়েছে ১২ হাজার টাকা। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা একটি আনার গাছের দাম ১৫ হাজার টাকা। এই আনার অন্য আনারের চেয়ে খেতে সুস্বাদু ও আকারে বড়।
বৃক্ষমেলার বন অধিদপ্তরের তথ্যকেন্দ্রের তথ্য মতে, বৃক্ষমেলা শুধু বিভিন্ন গাছের চারা কেনাবেচার উৎসব নয়, এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বার্তা পৌঁছে দেওয়াই হলো প্রধান লক্ষ্য। এবারের মেলায় ১১২টি স্টল রয়েছে, যার মধ্যে ৯২টি নার্সারি। এ ছাড়া কফি, স্ন্যাকস, আইসক্রিম পার্লার, খাবার হোটেলসহ নানা স্টল রয়েছে।
নরসিংদীর শিবপুর থেকে মেলায় স্টল বরাদ্দ পেয়েছে মেসার্স পল্লী নার্সারি সেন্টার। এটির বিক্রয়কর্মী কামরুল ইসলাম জানান, মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভালোই সাড়া পাচ্ছেন। তাঁদের স্টলে বিভিন্ন জাতের গোলাপ ফুলের চারা রয়েছে। একটি গোলাপের চারার দাম ২০০ থেকে ৯০০ টাকা।
লাখ টাকার বনসাই বটগাছ দেখান উইনার নার্সারির স্বত্বাধিকারী খালিদ হোসেন। তিনি জানান, শৌখিন মানুষ অফিস ও বাসায় রাখার জন্য বনসাই কিনে থাকে। এই বনসাইসহ অনেক গাছের চারা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় নার্সারি মালিকদের। আবার বীজ আমদানি করে চারা উৎপাদন ও কলমের মাধ্যমে নতুন গাছ তৈরি করা হয়। তিনি জানান, থাই জাম্বুরার একটি গাছের দাম সাত হাজার টাকা। এর ভেতরের কোয়াগুলো গোলাপি। এ ছাড়া করবী ফুলগাছের দাম ৪০০ টাকা, ইরানের মাল্টাগাছের দাম এক হাজার ৫০০ টাকা। সেখানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, ভারত ও বাংলাদেশের সংমিশ্রণে কাঁঠালগাছ। এই কাঁঠালের রং গোলাপি। খেতে খুব মিষ্টি। গাছটির দাম ১৫ হাজার টাকা। নারকেল ও সুপারিগাছের সমাহার দেখা গেল এনার্জি প্যাক অ্যাগ্রো লিমিটেডের স্টলে। স্টলটির বিক্রয়কর্মী আরিফুর রহমান বলেন, মালয়েশিয়ান, শ্রীলঙ্কান, ভিয়েতনামি, মায়ানমার ও বারি-৪ জাতের নারকেলের চারা আছে। এসব চারার দাম ৪০০ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। আর ভিয়েতনামের সুপারির চারার দাম ৪০০ টাকা এবং বার্মিজ সুপারির চারার দাম ১৫০ টাকা। একটি থাই সফেদগাছের দাম ৯ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য, সারা বছর গাছ বা বৃক্ষ রোপণ করা গেলেও ষড়ঋতুর বাংলাদেশে গাছ লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বর্ষা ও শরৎকাল। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন—এই চার মাস গাছ লাগানোর মোক্ষম সময়। এ সময় আলো-বাতাস, অনুকূল তাপমাত্রা, বৃষ্টি পর্যাপ্ত থাকে বলে চারাও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশে বৃক্ষরোপণের মৌসুম সামনে রেখে প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বৃক্ষমেলা শুরু হয়। কিন্তু ঈদের কারণে এবার ২৫ জুন শুরু হয়েছে।