ঢাকা   মঙ্গলবার
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
৩১ ভাদ্র ১৪৩২, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

সীমান্তে অবৈধ গরু-মহিষের ব্যবসা, সক্রিয় চোরাকারবারিরা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সীমান্তে অবৈধ গরু-মহিষের ব্যবসা, সক্রিয় চোরাকারবারিরা

ছাতক-দোয়ারাবাজার রুট ভারতীয় চোরাই গরু-মহিষের নিরাপদ করিডোরে পরিণত হয়েছে। অবৈধ পথে আসা ভারতীয় পশুর হাটগুলোতে চলছে রমরমা রসিদ বাণিজ্য। গরু-মহিষ ভারতীয় হলেও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে ইজারাকৃত পশুর হাটের রসিদেই অবৈধ পথে আসা পশু বৈধতা পাচ্ছে। যে কারণে এসব পশু আটক করতে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আটক হলেও রসিদের জোরে আদালত থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে স্থানীয় চোরাই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্র।

রসিদের ওপর ভর করে নির্দ্বিধায় দিনে-রাতে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকা থেকে ছাতক হয়ে শত শত ভারতীয় গরু-মহিষ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এসব গরু-মহিষ ঘিরে বছরে হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে ভারতে। প্রায় সময়ই চোরাকারবারিদের হামলায় বিজিবি, পুলিশ ও স্থানীয় সাংবাদিকরা আহত হচ্ছেন। এমনকি বিএসএফের গুলিতে চোরাকারবারিদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দোয়ারাবাজারে নেই কোনো গরু-মহিষ উৎপাদনের খামার। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়েও নেই উৎপাদন সংক্রান্ত কোনো তথ্য। উৎপাদন ব্যবস্থা না থাকলেও বাজারের আশপাশে গড়ে উঠেছে গরু-মহিষ রাখার একাধিক শেড। প্রশাসনের নাকের ডগায় ভারত থেকে অবৈধ পথে আসা গরু-মহিষকে পশুর হাটের ইজারাদারের রসিদ দিয়ে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় সরকারের দেওয়া ইজারার সুবাদেই এখানকার অবৈধ পশু বেচাকেনা চলছে। উপজেলায় ভোগলা, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীপুর, লিয়াকতগঞ্জ, বালিউরা, শ্রীপুর, নরসিংপুরসহ মোট ৭টি পশুর হাট রয়েছে। এর মধ্যে সীমান্তঘেঁষা বাংলাবাজার, ভোগলাবাজার ও নরসিংপুর পশুর হাট যেন সোনার হরিণ। এসব বাজারের ইজারা মূল্য দেড় থেকে তিন কোটি টাকা। বাজারে দেশি পশুর তেমন বেচাকেনা না থাকলেও ভারত থেকে আসা গরু-মহিষের রসিদ বিক্রিই তাদের মূল ব্যবসা। 

ইতোপূর্বে ভোগলাবাজার রসিদ বিক্রির শীর্ষে থাকলেও বর্তমানে সে স্থান দখল করেছে বাংলাবাজার পশুর হাট। এই বাজারের আশপাশে ভারতীয় গরু-মহিষ রাখার জন্য গড়ে উঠেছে একাধিক শেড। সীমান্ত অতিক্রম করে শেডে প্রবেশ করলেই রসিদের মাধ্যমে তা দেশীয় পশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের শতাধিক সদস্য ক্রেতা-বিক্রেতা সেজেই চালাচ্ছে রসিদ বাণিজ্য।

সিন্ডিকেটের মূল হোতা কারা– এ বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধানকালে স্থানীয়রা জানান, গরু-মহিষ চোরাচালান সিন্ডিকেটের হোতা শ্রীপুরের আহাদ আলী, নরসিংপুর বাজার ইজারাদার আব্দুল মতিন ও বালিউরার সালেহ আহমদসহ শতাধিক সদস্য রয়েছেন। ভারতীয় গরু-মহিষ ঘিরে উপজেলা সীমান্ত এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে বিশাল সিন্ডিকেট। গরু-মহিষের পাশাপাশি অবাধে দেশে ঢুকছে মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য। মাদক ও অন্যান্য পণ্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় আটক হলেও রসিদ নিয়ে নিরাপদে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে গরু-মহিষ। মাঝেমধ্যে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি গরু-মহিষ আটক করলেও অভিযোগ আছে, সেগুলো লোক দেখানো। প্রতি মাসে একটি বড় চালান বিজিবিকে ধরতে দেওয়ার সুযোগও সিন্ডিকেট তৈরি করে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ৯০টি গরু আটকের পর জিম্মাদাররা তা পরিবর্তনের অভিযোগে আদালতের নির্দেশনায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। 

এসব গরু-মহিষ ভারত থেকে নামাতে হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে অর্থ লেনদেন করে থাকেন ভোগলা এলাকার মন্তাজ আলীর ছেলে সারফুল। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন তার শ্যালক পলাশ আহমদ। অভিযোগ আছে, কলাউড়া গ্রামের ফয়েজ নামে এক ব্যক্তি বিজিবির নাম ভাঙিয়ে টাকা তোলেন। 

এ ছাড়া পেকপাড়া গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য খুরশিদ আলী, কলাউড়ার রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে ইমাম ও কাসেম, আনোয়ারসহ অনেকে বড় চোরাকারবারি হিসেবে পরিচিত।

দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামে ৬৭ জন সরাসরি এই চোরাচালান ব্যবসায় জড়িত বলে জানা গেছে। তাদের পেছনে মদদদাতা রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েক নেতা। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। আটক করা পশু বা অন্য কোনো মালামাল নিলামে তুললে সেটি সিন্ডিকেট সদস্যরাই কিনে নেয়। অন্য কেউ কিনলে দিতে হয় মোটা জরিমানা।

এক হিসাবে দেখা গেছে, শুধু রসিদ বিক্রি করেই ইজারাদাররা বছরে হাতিয়ে নিচ্ছেন ৩৫/৪০ কোটি টাকা। গত এক মাসের হিসাবে দেখা গেছে, দোয়ারাবাজার থেকে ছাতক হয়ে ট্রাকে পরিবহন করে প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার গরু-মহিষ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বার্ষিক হিসাবে এর বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

বালিউরা বাজারের ইজারাদার মাসুক, নরসিংপুরের বাজারের ইজারাদার আব্দুল মতিন, বাংলাবাজারের সুমন সবাই রসিদ বাণিজ্যের বিষয় অস্বীকার করে বলেন, বাজারে পশু নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতারা এলে নিয়ম মেনেই তারা রসিদ দেন। 

বালিউরা বাজারের সাবেক ইজারাদার ফজলুর রহমান রসিদ বাণিজ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। একই বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাবাজারের দায়িত্বে থাকা জয়নাল নামে আরও একজন।  

রসিদ বাণিজ্য ও বাজারের আশপাশে শেড গড়ে ওঠার বিষয় স্বীকার করে দোয়ারাবাজারের ইউএনও অরূপ রতন সিং বলেন, সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের সঙ্গে তিনিও কিছুটা মিল পেয়েছেন। পশুর হাটের এত কাছাকাছি পশু রাখার শেড থাকার কথা না। এসব বিষয়ে উপজেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। সীমান্ত এলাকার বাজারগুলো সীমান্ত থেকে সদর এলাকায় স্থানান্তর করার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।

সুনামগঞ্জ বিজিবি-২৮ ব্যাটালিয়ানের সিইও লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাকারিয়া কাদির বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি তৎপর। গরু-মহিষ অবৈধ প্রবেশের বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়মিত টহলের পাশাপাশি বিশেষ অভিযান চলছে। সূত্র: সমকাল

সর্বশেষ