ঢাকা   মঙ্গলবার
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
৩১ ভাদ্র ১৪৩২, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জ উচ্চ হিটশক, তাপ সহনশীল ধান উদ্ভাবনের চেষ্টা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জ উচ্চ হিটশক, তাপ সহনশীল ধান উদ্ভাবনের চেষ্টা

ধানগাছ সাধারণত গরম আবহাওয়া পছন্দ করে। তবে ফুল ফোটার সময় যদি রাতের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে ফলন কমে এবং দানা চকচকে হওয়ার বদলে ‘সাদা’ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) এক গবেষণায় ২৪ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাতের গড় তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ফলন ১০ শতাংশ কমে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক ধান উৎপাদন এলাকায় রাতের তাপমাত্রা দিনের তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে বাড়ছে।

ফলে কৃষিতে উৎপাদনে নানামুখী শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালে দেশে হিটশক বা উচ্চ তাপমাত্রা দেখা দেয়। তখন প্রায় ৪৮ লাখ হেক্টর জমির ধান তাপে চিটা হয়ে যায়। সাধারণত ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু বোরো ধানের মৌসুমে দেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি হয়ে থাকে, যা চিন্তার কারণ।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ও গবেষণার প্রধান অ্যান্ড্রু হাল্টগ্রেন জানিয়েছেন, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী ক্যালোরি উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশ কমবে। গবেষণায় দেখা গেছে, রাতের তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে ধানের দানার ফলন প্রায় ৭ শতাংশ কমে যায় (রাতের ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলো সর্বোত্তম) এবং দিনের তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে ফলন প্রায় ৬ শতাংশ হ্রাস পায় (দিনের ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোত্তম)। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে  উদ্ভিদের বন্ধ্যত্বও বাড়ে, যা দানা গঠনে প্রভাব ফেলে।

উচ্চ তাপমাত্রা ধানের পুষ্টিগুণকেও প্রভাবিত করে।

বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধানগাছ ঠাণ্ডা রাখতে বাতাসের চেয়ে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি কম তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয়, যার জন্য গাছ প্রচুর পানি বের করে দেয়। তীব্র গরম ও বৃষ্টিহীন সময়ে এই প্রক্রিয়ায় শীষ ও পাতায় পানি দ্রুত বের হয়ে গিয়ে তা শুকিয়ে যেতে পারে। তবে সব শীষ একসঙ্গে না বের হওয়ায় সম্পূর্ণ ক্ষতির আশঙ্কা কম। যেসব গাছে দানা গঠনের কাজ চলছিল, সেখানে পাতার কিছু অংশ শুকালেও কাণ্ডে জমা খাদ্যের কারণে দানা গঠন বেশির ভাগ সময় ঠিকঠাক চলে, ফলে ক্ষতি কম হয়।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধানগাছের জন্য ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযোগী। তবে ফুল ফোটা এবং ফুল ফোটার পর যখন ধানের শীষে দানা গঠিত হতে শুরু করে, প্রতিটি দানায় ধীরে ধীরে শর্করা, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি জমা হতে থাকার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে ফলন কমে যায় এবং দানার গুণমানও খারাপ হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধানগাছের বৃদ্ধি বিভিন্ন পর‌্যায়ে তাপের প্রভাবে ভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। চিটা দানা বাড়ে এবং ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অর্ধপুষ্ট দানা বেড়ে যায় এবং ফলন ও মান কমে। ফুল ফোটার সময় ধানের শীষ খুব সক্রিয় থাকে। অতিরিক্ত গরমে শীষকে রক্ষা করতে গাছ প্রচুর পানি প্রস্বেদন করে, যা একটি প্রাকৃতিক কুলিং সিস্টেমের মতো কাজ করে।

এসব আশঙ্কা থেকেই ২০১২ সালে উচ্চতাপ সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেওয়া হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে। গত ১৩ বছর ধরে অধিক তাপ সহ্য করতে পারে এমন জাতের ধান উদ্ভাবনে কাজ করছেন ধান বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখনো সাফল্য মেলেনি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাফল্য পেতে আরো অন্তত তিন বছর লাগতে পারে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা জনপ্রিয় বোরো জাত বিরি ধান ২৮-কে উচ্চতাপ সহিষ্ণু এন২২-এর সঙ্গে সংকরায়ন করে একটি অগ্রগামী সারি তৈরি করেছেন, যা মধ্যম মাত্রার উচ্চতাপ সহ্য করতে পারে। এই সারিটির আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষা করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘আমরা গবেষণায় চূড়ান্ত পর‌্যায়ে পৌঁছেছিলাম। পরে গবেষণায় দেখা গেছে, চালে অ্যামাইলেজ কম। ফলে বিষয়টি নিয়ে আরো ভাবতে হবে।’

প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান ড. খোন্দকার মো. ইফতেখারুদ্দৌলা বলেন, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ইরির সঙ্গে মিলে গবেষণা করা হচ্ছে। তবে সাফল্য পেতে আরো গবেষণা করতে হবে। এখন ইউএসএসের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ চলবে বলে তিনি জানান। এই জাতের ধান উদ্ভাবনের জন্য একটি প্রকল্পও চলমান রয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে চীনের একদল গবেষক সম্প্রতি এমন একটি জিন শনাক্ত করেছেন, যা তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সক্রিয় হয়ে ধানের ফলন কমিয়ে দেয় এবং দানার রং ফিকে বানিয়ে স্বাদও নষ্ট করে। গবেষকরা জানিয়েছেন, জিন এডিটিং অথবা প্রাকৃতিক ভিন্নতার মাধ্যমে জিনটি বন্ধ করা হলে ধানের উৎপাদন যেমন বাড়ে, তেমনি দানার মানও উন্নত হয়। এই আবিষ্কারকে গবেষক ইয়িবো লি বলেছেন, উচ্চ ফলনশীল ও তাপ সহনশীল উন্নত ধান জাত তৈরিতে একটি বড় অগ্রগতি।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, তাপের প্রভাবে ফসলের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে তাপ সহনশীল নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে কৃষির সব সংস্থাই কাজ করছে। এরই মধ্যে সবজির বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। ধানেরও নতুন জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে অনেকে আগে থেকেই। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আরো পরিকল্পনা গ্রহণ ও সে আলোকে বাস্তবায়ন করতে হবে। সূত্র: কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ