ঢাকা   রোববার
২২ জুন ২০২৫
৭ আষাঢ় ১৪৩২, ২৫ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী কাউনের চাষ

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:০৫, ২২ জুন ২০২৫

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী কাউনের চাষ

দিনাজপুরের বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও ঘোড়াঘাটসহ উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে একসময় জনপ্রিয় একটি খাদ্যশস্য ছিল কাউন, যার ইংরেজি নাম ফক্সটেল মিলেট। সহজ চাষযোগ্য, খরচ কম, পানি কম লাগে এবং খেতে সুস্বাদু হওয়া সত্ত্বেও আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী এই শস্যটি। সরকারি উদ্যোগের ঘাটতি ও বাজারে চাহিদার অভাবে চাষিদের আগ্রহ দিন দিন কমছে।

একসময় এই অঞ্চলের কৃষকের ঘরে ঘরে কাউন চাষ হতো।

কাউনের চাল থেকে তৈরি হতো খিচুড়ি, ক্ষীর, মলা ভাত, পিঠা-পায়েসসহ নানা পুষ্টিকর খাদ্য। এটি ছিল সহজপাচ্য এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর এক গ্রামীণ খাদ্যভাণ্ডার। কিন্তু আধুনিক চাষাবাদ, দ্রুত ফলন এবং উচ্চ লাভজনক ফসলের দিকে কৃষকদের ঝুঁকে পড়ার ফলে কাউনের স্থান দখল করেছে হাইব্রিড ধান, গম বা সবজি চাষ।

দিনাজপুরের অনেক প্রবীণ কৃষক আক্ষেপ করে বলছেন, ‘আমরা ছোটবেলায় কাউন খেয়ে বড় হয়েছি।

এখন কেউ চিনেই না এই শস্যটাকে।’ বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদের প্রবল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারায় হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী ফসল। তবে স্বল্প খরচ, অনাবাদি জমিতে সহজে চাষযোগ্য হওয়ায় অনেকেই মনে করছেন, যদি সরকার ও কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং বাজারে চাহিদা তৈরি করা যায়, তবে আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব কাউনের সুদিন।

কাউন শুধু একটি শস্য নয়, এটি বাংলার কৃষিসংস্কৃতির একটি প্রতীক।

সময়ের দাবিতে যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই ফসলটি রয়ে যাবে শুধু বইয়ের পাতায় ইতিহাসের একটি নাম হিসেবে।

একসময় প্রচুর কাউন চাষ হতো। আবার একসময় গরিবের প্রধান খাদ্যও ছিল এ কাউন। দিনের পর দিন মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে এখন আর সেভাবে এসব অঞ্চলে কাউন চাষ হয় না।

কালের আবর্তে কাউন চাষ হারিয়ে গেলেও নিজেদের খাওয়ার জন্য দিনাজপুরের বিরামপুর, নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাটের চর এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কাউন চাষ করা হয়েছে।

কাউন চাষ তেমন দেখা না গেলেও কাউনের চালের নানা ধরনের খাবার ধনীদের বিলাসী খাবারে পরিণত হয়েছে। তাই এটা চাষ করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে, বললেন কয়েকজন কৃষক। তাঁরা এলাকার আত্রাই নদীর পাশের জমিতে চাষ করছেন এ কাউন। উপজেলাগুলোর কয়েক জায়গায় হাতে গোনা কয়েকজন কাউনের চাষ করেন। কাউন চাষে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ে এবং কাউনগাছ থেকে জমির ভালো সার তৈরি হয়। কাউনের চাল বর্ণে হলুদ।

এর চালের ভাত খেতে খুবই সুস্বাদু। ছোট দানাবিশিষ্ট কাউন চালের পায়েসের স্বাদ দারুণ। এ ছাড়া এ চাল দিয়ে নানা ধরনের খাবারও তৈরি করা যায়। মিষ্টান্ন পায়েস, ক্ষীর ও ঝাল খাবার হিসেবে খিচুড়ি, পোলাও রান্নায় কাউন চাল এখন ধনীদের প্রিয় খাবার।

এটি একটি পুরনো চাষ। এতে পানি ও সার কম লাগে। মানুষজন কাউনের ভাত, পায়েস ও মুড়ি খায়। এ ছাড়া কাউন জন্ডিস রোগের উপকার করে। কিন্তু এখন দিন দিন কাউন হারিয়ে যাচ্ছে। এখন খাওয়ার জন্য বাজারে কাউন খুঁজলেও পাওয়া যাচ্ছে না।

তিন দশক আগে জমিতে কাউন চাষ হতো। একসময় যেসব চরভূমিতে সোনালি কাউনের ঢেউ উঠত, সেখানে এখন চাষ হচ্ছে ধান, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়াসহ নানা বাণিজ্যিক ফসল। বর্তমান ধারায় পরিবর্তন না এলে এক দশকের মধ্যেই চরাঞ্চল থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে কাউন। এটি শুধু ফসলচক্রের পরিবর্তন নয়, বরং একটি গ্রামীণ খাদ্য ঐতিহ্যের অবক্ষয়।

চাষিরা বলেন, ‘এ শস্য এখন আর যুগোপযোগী নয়। আগে বন্যার কারণে ধান হতো না। তখন কাউনই ছিল ভাত। এখন হাইব্রিড ধান করি, ভুট্টাও হয় ভালো। কেউ আর কাউন খায় না। একসময় নিয়মিত কাউনের ভাত খেত। শরীরেও শক্তি পাওয়া যেত। এখন সেই স্বাদই ভুলে গেছে মানুষ।’

তবে কাউন পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। বর্তমানে এটি পাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন পাখিপ্রেমীরাই কাউনের বড় ক্রেতা। একসময়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্য আজ পরিণত হয়েছে প্রান্তিক পণ্যে, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির দিক থেকেও।

ঘোড়াঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান জানান, ছোট দানাবিশিষ্ট কাউন প্রায় সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়। তবে পানি জমে না এমন বেলে দো-আঁশ মাটিতে এর ফলন ভালো হয়। আগের মতো এখন আর কাউন চাষ হয় না। কাউন একটা বিলুপ্ত প্রায় ফসল। এবার ঘোড়াঘাট উপজেলায় ০.২ হেক্টর জমিতে কাউন চাষ হয়েছে। এর মধ্যে অনেক জমিতে কাউনের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে ্অন্য ফসলের চাষ করা হয়েছে। দেশে এখন দানাদার শস্য বোরো ধান, ভুট্টা, গমসহ বিভিন্ন ফসল লাভজনকভাবে চাষ হওয়ায় কৃষকরা অধিক লাভের আশায় কাউনের পরিবর্তনে এসব ফসল চাষ করছে।