
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সম্প্রতি ধানের নতুন ছয়টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব জাত দেশের উপকূলীয়, দুর্যোগপ্রবণ ও রোগ-বালাইয়ের ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে ধান উৎপাদনের নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে।
গত ১৮ জুন জাতীয় বীজ বোর্ডের (এনএসবি) ১৪৪তম সভায় সম্প্রতি তিনটি নতুন জাত (ব্রি ধান ১১২, ১১৩ ও ১১৪) চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। এর আগে মার্চ মাসে ১১৩তম সভায় আরো তিনটি জাত (ব্রি ধান ১০৯, ১১০ ও ১১১) অনুমোদিত হয়েছিল।
এই নতুন জাতগুলো খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ সহনশীল কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
ব্রি ধান ১১২ : উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য লবণাক্ততা সহনশীল এই রোপা আমন জাতটি চারা অবস্থায় ১২ ডিএস/মি (প্রতি মিটারে মাটির লবনাক্ততা বোঝাতে ব্যবহৃত একক) তিন সপ্তাহ পর্যন্ত এবং প্রজনন পর্যায়ে ৮ ডিএস/মি পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। জাতটির জীবনকাল মাঝারি এবং হেক্টরপ্রতি ফলন ৪.১৪ থেকে ৬.১২ টন পর্যন্ত। এই জাতের শীষে গড়ে ২১০টি পূর্ণ দানা পাওয়া যায় এবং গাছ সহজে ঢলে পড়ে না।
চাল মাঝারি চিকন, সাদা রঙের এবং রান্নার পর ভাত ঝরঝরে হয়।
ব্রি ধান ১১৩ : ব্রি ধান ২৯-এর বিকল্প হিসেবে এই উচ্চফলনশীল বোরো জাতটি কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি মাঝারি মেয়াদি জাত, গড় ফলন ৮.১৫ টন/হেক্টর এবং সর্বোচ্চ ফলন ১০.১ টন। চাল মাঝারি চিকন, রং সাদা এবং ভাত ঝরঝরে।
এতে প্রোটিনের পরিমাণ ৮.৪ শতাংশ এবং অ্যামাইলোজ ২৮ শতাংশ। গাছ মজবুত ও শক্ত হওয়ায় এটি সহজে হেলে পড়ে না।
ব্রি ধান ১১৪ : ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী এই জাতটি বোরো মৌসুমে চাষের উপযোগী। এতে পিআই ৯ নামের প্রতিরোধী জিন সংযোজন করা হয়েছে। এই জাতের গড় ফলন ৭.৭৬ টন/হেক্টর এবং সর্বোচ্চ ফলন ১০.২৩ টন পর্যন্ত।
জীবনকাল ১৪৯ দিন। চাল মাঝারি মোটা, সোনালি বর্ণের। এতে অ্যামাইলোজ ২৭ শতাংশ, প্রোটিন ৭.৭ শতাংশ রয়েছে। পুষ্টিমান এবং উৎপাদনশীলতার দিক দিয়ে এই জাতটিও বেশ এগিয়ে।
ব্রি ধান ১০৯ : বিশেষভাবে উপকূলীয় অঞ্চল বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের জন্য উপযোগী। জাতটির উচ্চতা ১২৮ সেন্টিমিটার এবং জীবনকাল ১৪৭ দিন। স্বাভাবিক পরিবেশে প্রতি হেক্টরে ফলন ৬.৩২ টন এবং জোয়ারভাটা এলাকার মতো প্রতিকূল পরিবেশে ৫.৪০ টন। সঠিক পরিচর্যায় ফলন ৬.৫০ টন পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে। চাল লম্বা-মাঝারি মোটা, ঝরঝরে, অ্যামাইলোজ ২৫.৪ শতাংশ এবং প্রোটিন ১০.৬ শতাংশ।
ব্রি ধান ১১০ : আকস্মিক বন্যা সহনশীল এই জাত ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও রংপুর অঞ্চলের জন্য উপযোগী। গাছের উচ্চতা ১২০ সেন্টিমিটার এবং এটি দুই সপ্তাহের জলাবদ্ধতা সহ্য করতে সক্ষম। জীবনকাল গড়ে ১২৩ দিন এবং বন্যা পরিস্থিতিতে তা হয় ১৩৩ দিন। গড় ফলন ছয় টন/হেক্টর, বন্যার সময় পাঁচ টন পর্যন্ত। চাল মাঝারি চিকন, গোলাপি আভাযুক্ত লিফ শিথ এই জাতের একটি বৈশিষ্ট্য। প্রোটিনের পরিমাণ ৮.৮ শতাংশ এবং অ্যামাইলোজ ২৪ শতাংশ।
ব্রি ধান ১১১ : এই জাতটি রোপা আমন মৌসুমে হাওর ও নিম্নাঞ্চলের জন্য উপযুক্ত, যেখানে এক মিটার পানির নিচে ধান চাষ করতে হয়। গাছের উচ্চতা ১৬২ সেন্টিমিটার, কাণ্ড বাঁশের মতো শক্ত এবং বহু বর্ষজীবী। এই জাতের শর্করার পরিমাণ প্রচলিত জাতের তুলনায় তিন গুণ বেশি। এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৪.৩ থেকে ৪.৭ টন। চাল মাঝারি মোটা এবং ভাত ঝরঝরে। রোগ-বালাই ও পোকামাকড় প্রতিরোধে এ জাতের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সায়েন্টিফিক অফিসার একলাসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এই ছয়টি জাত শুধু দুর্যোগ সহনশীলতা নয়, খাদ্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে কৃষকের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
গবেষক একলাসুর রহমান আরো বলেন, মূলত এই জাতগুলো মাঠ পর্যায়ে সিলেক্টিভ ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। কমপক্ষে ১৩-১৪ বছর সময় লাগে এই প্রক্রিয়ায়।