ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, দুর্বল। ডান পায়ের নখ নেই। বিশাল দেহ নিয়ে আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলছিল কোনো অজানা গন্তব্যে। কিন্তু আর যেন উড়তে পারছিল না শকুনটি। তাই হাল ছেড়ে পড়ে গেল মাটিতে; চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মাদ্রাসার আঙিনায়। সেখান থেকে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা মিলে এটিকে খাবার খাওয়ান। প্রথমে তারা এটিকে ভেবেছিলেন ঈগল। কারণ, তারা এমন পাখি আগে কখনও দেখেননি। পরে জানতে পারেন শকুন।
বিরল শকুনটি উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে উপজেলা থেকে কাঞ্চনা ইউনিয়নের উত্তর কাঞ্চনা এলাকায় এটি উদ্ধার করা হয়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বন বিভাগের লোকজনকে খবর দিলে তারা রাতেই এসে এটি নিজেদের হেফাজতে নেন।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, উদ্ধার শকুনটি ‘হিমালয়ান গৃধিনী’ নামে পরিচিত। প্রতিকূল পরিবেশ ও খাদ্য সংকটের কারণে বাংলাদেশে এ শকুন বিলুপ্তপ্রায়। এটি হিমালয় পর্বতের উঁচু স্থানে বসবাস করে। শীত শুরু হলে প্রচণ্ড ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে ভারত, নেপাল, ভুটান ও তিব্বত অঞ্চলের পাহাড় থেকে গরম আবহাওয়ার জন্য দক্ষিণ দিকে আসে। বাংলাদেশেও এদের দেখা পাওয়া যায়।
শকুনটির বৈজ্ঞানিক নাম জিপস হিমালয়ানসিস। এটি হিমালয় অঞ্চল ও তিব্বত মালভূমির স্থানীয় পাখি। ক্রমে এটি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এদের সংখ্যা কমছে। বিশাল ধূসর পাখা নিয়ে এরা আকাশের বেশ উঁচু দিয়ে উড়তে পছন্দ করে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এ শকুন প্রজাতি বর্তমানে আইইউএনসির (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার) লাল তালিকাভুক্ত। এগুলোকে ‘নিকট হুমকিতে থাকা’ পাখির ক্যাটেগরিতে রাখা হয়েছে। এ শকুনকে প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মীও বলা হয়। বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহ খেয়ে এরা পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। এ ছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম শিকারি পাখির মধ্যেও এরা নিজেদের নাম সদম্ভে টিকিয়ে রেখেছে।
বন বিভাগের সাতকানিয়া মাদার্শা রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. নাজমুল হোসেন বলেন, ‘প্রায় সাত কেজি ওজনের উদ্ধার হওয়া শকুনটির ডান পা ছিল না। দীর্ঘ পথ ওড়ার পর খাবার না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গেছে। আমরা শকুনটিকে খাবার দিয়েছি। এখন মোটামুটি সুস্থ। তবে ওড়ার সক্ষমতা নেই।’ তিনি জানান, শকুনটিকে কিছুটা সবল করে মঙ্গলবার রাতেই চুনতি অভয়ারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা (অভয়ারণ্য কর্তৃপক্ষ) গতকাল বুধবার সকালে চিকিৎসার জন্য ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।
হিমালয়ান শকুনটি উদ্ধারের বর্ণনায় নাজমুল হোসেন বলেন, ‘রাতেই স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। এর আগে বিকেলে শকুনটি ওই মাদ্রাসার আঙিনায় পড়ে। তখন শিক্ষক ও ছাত্ররা মিলে সেটিকে একটি ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়ায়।’ স্থানীয়দের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই এলাকায় আগে কেউ এমন কোনো পাখি দেখেনি। কেউ বলছিল, এটি ঈগল। কেউ বলছিল, ঈগল নয়, অন্য কিছু। খুব বয়স্ক কয়েকজন চিনতে পারেন যে এটি শকুন।’
তিনি বলেন, দুই পাখা মেললে এটির আকার প্রায় দুই মিটার। ওজন সাত কেজির মতো। এটি একটি প্রাপ্তবয়স্ক হিমালয়ান শকুন। শীতে এ প্রজাতির শকুন হিমালয় ও আশপাশের এলাকা থেকে একটু বেশি তাপমাত্রার এলাকায় উড়ে যায়। তাই বাংলাদেশে হিমালয়ান শকুনের দেখা মেলে। ডান পায়ের থাবার অংশটি নেই জানিয়ে মো. নাজমুল হোসেন বলেন, ‘ওই অংশে একটি পুরোনো আঘাতের চিহ্ন আছে। তবে এটি এক পায়ে দাঁড়াতে পারে।’
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনজুরুল আলম বলেন, শকুনটি দুই পায়েই আঘাত পেয়েছে। এটিকে সুস্থ করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শকুনটি চিকিৎসায় সেরে উঠে স্বাভাবিক চলাচলে সমর্থ হলে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হবে।























