দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের অধিকাংশ ব্রয়লার খামারে সুস্থ মুরগিকে অপ্রয়োজনীয় ‘প্রতিরোধমূলক’ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। খামার পরিচালনায় কোনো প্রশিক্ষণ না থাকায় চিকিৎসাজ্ঞানহীন এক শ্রেণির ডিলারদের পরামর্শে খামারিরা ওই সব ওষুধ প্রয়োগ করেন। ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বাড়াতেই ডিলাররা খামারিদের অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে প্ররোচিত করে থাকেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রয়লার মুরগির খামারে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার খামারে থাকা সব ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী করে তুলতে পারে।
এই ব্যাকটেরিয়াগুলির মধ্যে অনেকগুলি, যেমন সালমোনেলা এবং ই-কোলাই, মানুষকে সংক্রামিত করতে পারে। যেহেতু এই ব্যাকটেরিয়াগুলি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে, তাই এই সংক্রমণে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তবে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতাধীন খামারিরা কম্পানিগুলো থেকে প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত পরামর্শ পেয়ে অহেতুক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। রোগ প্রতিরোধের চেয়ে সংক্রমন এড়াতে বেশি যত্নবান থাকেন।
খামার ঘিরে জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এ পদ্ধতিতে মুরগির ঘরে প্রবেশের আগে হাত-পা ধোয়া এবং মুরগির ঘরের চারপাশে বেড়া তৈরি করা হয়। জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলি মুরগির ঘরে জীবাণু প্রবেশ করতে বাধা দেয়। চুক্তিবদ্ধ খামারিদের সুস্থ মুরগিকে কোনও প্রতিরোধমূলক অ্যান্টিবায়োটিক না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, কারণ কম্পানিগুলি একে অ্যান্টিবায়োটিকের অপচয় (অপ্রয়োজনীয় খরচ) হিসাবে দেখে।
রংপুর, পীরগঞ্জের সানেরহাটের মো. ইমরান মন্ডল (২৮) স্নাতক পাস শেষে চাকরি না পেয়ে বসতভিটা সংলগ্ন জমিতে মুরগির খামার করেছেন। ইমরান জানান, খামারে বাচ্চা তোলার পর থেকে বিক্রির আগ পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক দিই। ডিলার যখন যেটা দেয় সেটাই খাওয়াই। এক হাজার মুরগির ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য ডিলারকে প্রায় হাজার দশেক টাকা দিতে হয়।’
একই জেলার কাউনিয়ার মাছহারির খামারি মো. নূর আলম (৩৮) জানান, “২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কম্পানির ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও খামার মুরগির মড়ক ঠেকাতে পারিনি।
অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও মুরগির ওজন আশানুরূপ বাড়াতে পারিনি। তবে বর্তমানে কম্পানির সাথে কন্ট্রাক্টে তিন হাজার মুরগি পালনে আমার কোনো ওষুধ কিনতে হয় না। কম্পানির তদারকিতে বায়োসিকিওরিটি অনুসরণের পাশপাশি নিয়মিত চিকিত্সকের পরামর্শ মেনে চলছি। তারা খামারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নিরম্নত্সাহিত করেন।”
করোনাকালে চাকরি হারিয়ে ব্রয়লার মুরগির খামার করেছেন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার বড় হাসিমপুরের মোকছেদুল হক (৪৪)। তিনি বলেন, “কাজী ফার্মের কর্মীরা আমাকে কম খরচে সুস্থ মুরগি পালনের পরামর্শ দিয়েছেন। তারা আমাকে সুস্থ একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা এবং ভালো খাবার দিয়েছেন। মুরগির জন্য অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে টাকা খরচ না করিয়ে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী খামার পরিচালনায় নিয়মিত সহায়তা করেছেন। আর তা মেনে চলার কারণে সাম্প্রতিক এক ব্যচের মুরগি পালন করে কম্পানি থেকে ৭১ হাজার টাকা আয় করেছি।”
পক্ষান্তরে একই থানার খামারি মো. আহসান হাবিব (৪৬) বলেন, ‘দুই বছর ধরে এক হাজার মুরগির খামার করে অনেক ওষুধ কম্পানির অ্যান্টিবায়োটিকের সাথে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু খামারে যত টাকার ওষুধ আর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছি ততো টাকা লাভ করতে পারিনি। এক ব্যাচে বাধ্যতামূলক তিন দফায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য পরে বুঝেছি যে, ডিলার নিজের বাড়তি লাভের জন্যই অহেতুক ওষুধ দিত।’
এ বিষয়ে রংপুর অঞ্চলের পোল্ট্রি খামারিদের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করা ভেটেরনারী চিকিত্সক মো. নেওয়াজ শরীফ বলেন, মানুষের মত পশু পাখির চিকিত্সায়ও ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ। তিনি আরো বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত, অনেক খামারি খামার পরিচালনার সঠিক নিয়মকানুন এবং পদ্ধতি জানেন না। ডিলাররা প্রান্তিক খামারিদের অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। মুরগির রোগ প্রতিরোধ এবং ওজন বৃদ্ধির প্রলোভন দেখিয়ে তারা এটি করে।”
ডা. নেওয়াজ বলেন, “ব্রয়লার মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার পর, মুরগি বিক্রি করার আগে খামারিদের অবশ্যই “প্রত্যাহারের সময়কাল” বজায় রাখতে হবে, অন্যথায় মুরগির মাংসে “অবশিষ্ট” অ্যান্টিবায়োটিক থাকতে পারে।”
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য খাতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোগত্বত্ত, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ভাইরাসবিদ) অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন হাবিব নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, “পোল্ট্রি খাতের অনেক খামারে অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। মুরগির খামারে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে মানুষের রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু ওষুধ কার্যকরিতা হারাচ্ছে।” এ অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে মুরগির খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অপরিহার্যতার কথাও ব্যক্ত করেন।























