
উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও গাইবান্ধা জেলায় অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে রংপুরে অন্তত আটজনের শরীরে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। পাশাপাশি সেখানকার কিছু বাড়ির ফ্রিজে রাখা গরুর মাংসেও অ্যানথ্রাক্স জীবাণু শনাক্ত হওয়ায় এলাকায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০২২ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সাতটি জেলায় অ্যানথ্রাক্সের ১৫টি প্রাদুর্ভাবের তথ্য পাওয়া গেছে।
এই সময়ের মধ্যে ২৪৬ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। তবে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
চলতি ২০২৫ সালে ৯৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫৬ জনের দেহে অ্যানথ্রাক্স পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালে ৫০, ২০২৩ সালে ৭৮ এবং ২০২২ সালে ৬২ জনের দেহে এই রোগ শনাক্ত হয়।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর দুটি প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে একটি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা, অন্যটি রংপুরের পীরগাছা উপজেলা। এর বাইরে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে। তবে আইইডিসিআরের তথ্যে তা পাওয়া যায়নি।
এদিকে কালের কণ্ঠের রংপুর ও গাইবান্ধা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বলা হয়েছে, রংপুরের পীরগাছা উপজেলার সদর ও পারুল ইউনিয়ন ঘুরে অর্ধশতাধিক সন্দেহভাজন (সাসপেক্টেড) অ্যানথ্রাক্স রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে। গত দুই মাসে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে তিন শতাধিক গবাদি পশু মারা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, চলতি বছর সেখানে অন্তত ৪০০ জন উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে তাঁদের কারো নমুনা পরীক্ষায় অ্যানথ্রাক্স নিশ্চিত করা হয়নি।
কী এই অ্যানথ্রাক্স?
অ্যানথ্রাক্স একটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগ।
সাধারণত মাটিতে থাকা জীবাণু ঘাস খাওয়ার সময় পশুর মুখ, শ্বাসনালি বা ত্বকের ক্ষত দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। এ রোগ সহজে প্রাণী থেকে প্রাণীতে ছড়ায় না, মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না এবং এটি হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বায়ুবাহিতও নয়।
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা সহজলভ্য এবং এতে মৃত্যুঝুঁকি তেমন একটা নেই। কিন্তু সংক্রমণ ঠেকাতে অসুস্থ গরু বা ছাগল জবাই বন্ধ করা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি অসুস্থ প্রাণী মারা গেলে ঝুঁকি এড়াতে মাটির গভীরে পুঁতে ফেলার পরামর্শ দেন তাঁরা।
রংপুরে কেন, কিভাবে ছড়াল?
সম্প্রতি আইইডিসিআরের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মো. আব্দুল্লাহ উমর নাসিফ রংপুরের পীরগাছা উপজেলা পরিদর্শনে যান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘রংপুরে এবারই প্রথম অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। কিভাবে এটি সেখানে ছড়াল, তা নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করছি। আক্রান্ত গবাদি পশুগুলো কোথা থেকে আনা হয়েছিল, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্স মানবদেহে সাধারণত পশুর মাংসের সংস্পর্শে ত্বকের ক্ষত দিয়ে প্রবেশ করে। কারো আগে থেকে ক্ষত থাকলে সে আরো ঝুঁকিতে থাকে।’
কোথায় কোথায় ছড়িয়েছে?
বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম শনাক্ত হয় পাবনায়। এরপর এটি ছড়িয়েছে সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রাজশাহী, নাটোর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম এবং সর্বশেষ রংপুর ও গাইবান্ধায়।
অ্যানথ্রাক্স কতটা বিপজ্জনক?
আইইডিসিআরের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আহমেদ নওশের আলম জানান, ‘বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের ৯৫ শতাংশই ত্বকে সীমাবদ্ধ। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসা গ্রহণ করলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। মৃত্যুর ঝুঁকি নেই বললেই চলে।’
তবে আন্তর্জাতিকভাবে আরো দুই ধরনের অ্যানথ্রাক্স রয়েছে—পাচনতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স, আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে ছড়ায়। এতে মৃত্যুহার ২৫-৭৫ শতাংশ এবং শ্বাসনালির অ্যানথ্রাক্স, অত্যন্ত বিরল ও মারাত্মক।
তবে বাংলাদেশে এখনো এই দুই ধরনের সংক্রমণ নিশ্চিত হয়নি। কারণ বাংলাদেশের মানুষ মাংস সাধারণত রান্না করেই খায়।
প্রতিরোধে কী করা হচ্ছে?
রংপুরের পীরগাছা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা একরামুল হক বলেন, ‘শুধু কৃষকদের অসচেতনতার কারণে উপজেলার প্রায় ১০০ গরু মারা গেছে। এরপর দ্রুত টিকাদান শুরু করা হয়। এখন আর কোনো গরু মারা যাচ্ছে না।’
তিনি আরো জানান, ‘এ পর্যন্ত ৫৩ হাজার ৪০০টি ভ্যাকসিন পাওয়া গেছে। আরো ৫০ হাজার চাহিদা দেওয়া হয়েছে।’
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ডিএলও) আবু ছাইদ বলেন, ‘রংপুরে প্রায় ১৩ লাখ গবাদি পশু রয়েছে। এর মধ্যে গত আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার পশুকে টিকা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে আক্রান্ত পশু পাওয়া যায়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ যাতে আতঙ্কিত না হয়, এ জন্য মসজিদ, মন্দির ও হাটবাজারে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় যত্রতত্র পশু জবাই ও মাংস বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে আমাদের ১২টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।’