
রংপুরের পীরগাছা সদর উপজেলার অনন্তরাম বড়বাড়ি গ্রামের বাবু মিয়ার খামারে আটটি গরু ছিল। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়ে গত মাসে দুটি মারা যায়। পরে আতঙ্কে বাকি ছয়টি গরু অর্ধেক দামে বিক্রি করে দেন তিনি। অন্যদিকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার দুই দিনে নতুন করে আরো ছয়জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
পীরগাছা উপজেলার আরেক খামারি হাবিবুর রহমানের খামারে সাতটি দেশীয় গরু ছিল। একটি গরুতে এই রোগ দেখা দিলে অন্যগুলো দ্রুত বিক্রি করে দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এটাই ছিল আমার সংসার। বছর শেষে বিক্রি করে যে আয় হতো তা নিয়ে পরের পুরো বছরের সংসারের খরচ চলত। বাকি টাকা দিয়ে ছোট ছোট বাছুর কিনে সেগুলো লালন-পালন করতাম। এখন পুঁজি শেষ। কেউ সহযোগিতা না করলে আর খামার করতে পারব না।’
পীরগাছার বাবু মিয়া ও হাবিবুর রহমানের মতো ছোট-বড় অনেক স্থানীয় খামারি কম দামে বাজারে গরু-ছাগল-ভেড়া বিক্রি করে দিচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কম দামে এসব পশু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কম দামে এসব পশু কিনে রাখছেন মাংস বিক্রেতারা।
রংপুর প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানায়, বিভাগের আট জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে গরুর খামারের সংখ্যা আট হাজার ৪৩৪টি। ছাগল-ভেড়ার খামারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৭২৬টি। এসব খামারে ৯৫ লাখ গরু ও ৯০ লাখ ছাগল-ভেড়া রয়েছে।
শুধু রংপুর জেলার আট উপজেলায় গরু-ছাগল-ভেড়া মিলে খামার রয়েছে চার হাজার ৫১৫টি। এর মধ্যে পীরগাছা উপজেলায় নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলে গরু-ছাগল-ভেড়ার ৬৩০টি খামার রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত জুনে এই উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হতে শুরু করে গরু। তা থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এদিকে পীরগাছা উপজেলার পাশাপাশি কাউনিয়া, মিঠাপুকুর ও পাশের সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়ও অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ মিলেছে। ফলে সেখানেও আতঙ্ক বিরাজ করছে খামারি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।
সর্বশেষ মিঠাপুকুরে ১১ জনের শরীরে উপসর্গ পায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিনিধিদল। অনেকেই এই আতঙ্কে খামারের পশু বিক্রি করছেন। অনেকে আবার চিকিত্সা করাচ্ছেন, ভ্যাকসিন নিচ্ছেন।
স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাস্তবতার চেয়ে আতঙ্কই বেশি ছড়ানো হচ্ছে।
এদিকে ঝুঁকি এড়াতে মাঠে প্রাণিসম্পদ বিভাগের একাধিক টিম কাজ করছে। গতকাল মঙ্গলবার প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. বয়জার রহমান পীরগাছাসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শ, ওষুধ ও ভ্যাকসিন সরবরাহ করার কথা বলেন তিনি।
অ্যানথ্রাক্সে সুন্দরগঞ্জে দুই দিনে নতুন আরো ৬ জন শনাক্ত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার এই দুই দিনে নতুন করে আরো ছয়জনসহ এ পর্যন্ত ২২ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
গাইবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গত ১ অক্টোবর থেকে গতকাল ৭ অক্টোবর পর্যন্ত যাঁরা অ্যানথ্রাক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিত্সা নিয়েছেন তাঁরা হলেন- মধ্য বেলকা গ্রামের সামিউল ইসলাম, সাহাদত্ হোসেন, সবুজ মিয়া, বেলকা নবাবগঞ্জ গ্রামের আজিজুল হক, পশ্চিম বেলকা গ্রামের ভুট্ট মিয়া, আতিকুর রহমান, শহিদুল ইসলাম, বেলকা গ্রামের মোজাহার আলী, মোজাফ্ফর হোসেন, খতিব মিয়া, ফরিদুল হক, রোজিনা বেগম, কিসামত সদর গ্রামের মোজা মিয়া, মাহবুর রহমান, শাফিকুল ইসলাম, স্বাধীন মিয়া, সকিনা বেগম, তাইজল মিয়া, শিশু ছায়ফান বেগম, আফরিন বেগম, ছালদিয়া ইসলাম ও রইসুল মিয়া।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দিবাকর বসাক বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ নিয়ে যাঁরা চিকিত্সা নিতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ গুরুতর অসুস্থ ছিলেন না। বেশির ভাগ রোীগ রাতে এসেছিল, সে কারণে তাদের ওষুধ দেওয়া সম্ভব হয়নি। গত দুই দিনে (সোম ও মঙ্গলবার) নতুন করে আরো ছয়জন চিকিত্সা নিয়েছেন। এ নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৬ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার দে বলেন, গরু-ছাগলকে অ্যানথ্রাক্স রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য উঠান বৈঠক, মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এটি ছোঁয়াছে রোগ নয়। পরীক্ষা করে আরো দুটি গরুর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে।