
পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী কাঁচামাটিয়া। এটি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার বাথাইল নদীতে পতিত হয়েছে। কাঁচামাটিয়া নদীর পারে আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে তখন বর্ষার পানিতে ভরে উঠত কাঁচামাটিয়া।
সঙ্গে আসত নানা প্রজাতির ছোট-বড় মাছ। বর্ষায় নদীর পানিতে নামলে চারপাশে বিদ্যুদেবগে ছোটাছুটি করত চেলা, বাঁশপাতা। চেলা, বাঁশপাতা তখন জনপ্রিয় কোনো মাছ ছিল না। সেই কাঁচামাটিয়া এখন প্রায় পানিশূন্য ক্ষীণাঙ্গী এক নদী।
পানির অভাবে প্রজননস্থল বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় নদীতে দেশীয় প্রজাতির অনেক ছোট মাছ এখন সংকটাপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায়। সংকটাপন্ন এমন একটি ছোট মাছ ‘নারকেলি চেলা’ নিয়ে আজ আলোচনা করব।
মিঠা পানির নারকেলি চেলার বৈজ্ঞানিক নাম Salmostoma bacaila (Hamilton, ১৮২২)। Danionidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই মাছটির ইংরেজি নাম Large razorbelly minnow।
অঞ্চলভেদে নারকেলি চেলা কাটারি নামেও পরিচিত। আমাদের মিঠা পানিতে নারকেলি চেলা ছাড়াও ফুল চেলা (Salmostoma phulu), ঘোড়া চেলা (Securicula gora), চাপ চেলা (Chela cachius) ও কাশ চেলা (Chela laubuca) নামে চেলার আরো পাঁচটি প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে ফুল চেলা আকারে বড়।
নারকেলি চেলার দেহ লম্বাটে এবং খুবই চাপা। দেহের রং উজ্জ্বল রুপালি, আঁষ খুবই ছোট।
মুখ তির্যক এবং নিচের চোয়াল ওপরের চোয়ালের চেয়ে লম্বা। এরা সাধারণত ধীরগতির পানিপ্রবাহে বসবাস করে। নদী, হ্রদ ও খালবিলে নারকেলি চেলা দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তানে এই মাছের বিস্তৃতি রয়েছে। নারকেলি চেলা পানির ওপরের স্তরে খাবার খায় এবং জুপ্লাংকটন, ছোট ছোট কীট ও পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একসময় এই মাছের প্রাচুর্য ছিল। বর্তমানে অন্যান্য দেশীয় ছোট মাছের মতো প্রাকৃতিক জলাশয়ে এই মাছের প্রাপ্যতাও ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রজাতিটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ইশতিয়াক হায়দার ২০২২ সালে রংপুরের চিকলী নদী থেকে নারকেলি চেলা সংগ্রহ করেন। এরপর ইনস্টিটিউটের সৈয়দপুর উপকেন্দ্রের গবেষণা পুকুরে প্রতিপালন করে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা একই বছর দেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে হ্যাচারিতে নারকেলি চেলার পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, নারকেলি চেলা মাছের প্রধান প্রজননকাল মে-জুলাই তবে এরা অক্টোবর-নভেম্বর এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেও প্রজনন করে থাকে। সমবয়সী স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের চেয়ে আকারে বড় হয়। একটি পরিপক্ব মা-মাছ থেকে বয়স ও ওজন ভেদে ১২ হাজার ৭০০ থেকে ২৪ হাজার ২০০ ডিম পাওয়া যায়। নারকেলি চেলা লম্বায় ১৮ সেন্টিমিটার এবং ওজনে ২৭ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী নারকেলি চেলা ১০-১২ গ্রাম হলেই প্রজননক্ষম হয়। ওভোহোম হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের সাত-আট ঘণ্টা পর স্ত্রী চেলা ডিম ছাড়তে শুরু করে।
নারকেলি চেলার চাহিদা ও পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন উৎসর নারকেলি চেলার বাহ্যিক গঠন ও বায়োলজি নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। এসব গবেষণায় নারকেলি চেলার প্রজননকাল, পুরুষ-স্ত্রী মাছের আনুপাতিক হার এবং প্রজননক্ষম মাছের আকার নির্ণয় করা হয়। গবেষণার তথ্য মতে, নারকেলি চেলার একটি পপুলেশনের মধ্যে ৬৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৪ শতাংশ স্ত্রী মাছ দেখা যায়। প্রজননকালে জলাশয়ে প্রজননক্ষম পুরুষ মাছের চেয়ে স্ত্রী মাছ দ্বিগুণের চেয়ে বেশি থাকে। গবেষণার এসব ফলাফল পরে ২০২২ সালে নারকেলি চেলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন সফলতা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বাজারে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে নারকেলি চেলা বিক্রি হয়। নারকেলি চেলার চচ্চড়ি খুবই জনপ্রিয় খাবার এবং সহজেই হজম হয়। নারকেলি চেলা আকারে ছোট হলেও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং মানবদেহের, বিশেষ করে বাড়ন্ত শিশু, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের জন্য খুবই উপকারী। প্রতি ১০০ গ্রাম নারকেলি চেলা মাছে ১৬.৯ শতাংশ আমিষ, ২৫৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২.১ মিলিগ্রাম লৌহ এবং ৬৩.১ মিলিগ্রাম ভিটামিন-এ রয়েছে। এসব অণুপুষ্টি বাড়ন্ত শিশুদের শারীরিক ও দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি এবং হাড় ও দাঁত মজবুত করে। তা ছাড়া নারকেলি চেলা রক্তশূন্যতা দূর করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। নারকেলি চেলার শুঁটকিতে খনিজ লবণের পরিমাণ তাজা মাছের চেয়ে বেশি থাকে, যা মানবদেহে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখে।
উল্লেখ্য, নারকেলি চেলার প্রজনন-প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হলেও এর চাষ-প্রযুক্তি আজও অজানা। চাষ-প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা গেলে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ নারকেলি চেলা সহজপ্রাপ্য হবে। একই সঙ্গে হ্যাচারিতে ব্যাপকভাবে নারকেলি চেলার পোনা উৎপাদন করে সরকারিভাবে হাওর ও বিল-ঝিলে অবমুক্ত করা যেতে পারে।