
বরিশালের আগৈলঝাড়া-গোপালগঞ্জ মহাসড়কের পাশে দাসেরহাট বাজার। ভোর হওয়ার আগেই সেখানে নেমে আসে এক ভিন্ন ব্যস্ততা। সারি সারি মিনি ট্রাক, নছিমন আর পিকআপভর্তি প্লাস্টিকের ড্রাম ও অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে সাজানো থাকে রুই, কাতল, পাঙ্গাশ আর তেলাপিয়ার পোনা। সকাল ৭টা বাজতেই বাজারের দ্বার খুলে যায়। মুহূর্তেই হাঁকডাক, দর-কষাকষি আর কোটি টাকার অঙ্কের হিসাব মিলিয়ে তৈরি হয় এক ঘণ্টার প্রাণবন্ত অর্থনীতি।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, মৌসুমের সময় প্রতিদিন মাত্র এই এক ঘণ্টার বাজারেই লেনদেন হয় কোটি টাকার বেশি। মৌসুমের ওঠানামা থাকলেও সারা বছর ঘুরে দাসেরহাট বাজারে আনুমানিক ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। ফলে ভোরের এই ক্ষণস্থায়ী বাজার এখন দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় মৌসুমি অর্থনৈতিক প্রবাহ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
শুধু একটি লেনদেন কেন্দ্র নয়, দাসেরহাট বাজারকে অনেকে বলেন দক্ষিণাঞ্চলের অঘোষিত শেয়ারবাজার। যেখানে মুহূর্তের মধ্যে পণ্যের দাম ওঠানামা করে, আর ক্ষুদ্র থেকে বড় ব্যবসায়ী সবাই মিলে তৈরি করেন এক অনন্য অর্থনৈতিক গতিশীলতা।
পোনা সরবরাহের শৃঙ্খল : দাসেরহাট বাজারের প্রাণশক্তি হলো বহুদূর থেকে আসা সরবরাহ। যশোরের বাবলাতলা অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয় রেণু ও বিশেষ প্রজাতির পোনা।
রাতভর ভ্যানে যাত্রা শেষে এগুলো পৌঁছায় আগৈলঝাড়ায়। স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পোনা বিক্রি করেন। এখান থেকে ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ভাঙ্গাসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি বাজারে সরবরাহ যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সেলিম ব্যাপারী, হালিম খলিফা, ইসমাইল সরদার, রুবেল শিকদার আর ভাষান সরদারের ভাষায়, ‘প্রতিদিন অন্তত ৫০ জন ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীর জন্য চাহিদা মেটাতে হয়। স্থানীয়ভাবে এত পোনা উৎপাদন সম্ভব নয়, তাই বাবলাতলা থেকেই আনতে হয়।
ভাড়ার অর্থনীতি : পোনা বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে দাসেরহাট বাজারে গড়ে উঠেছে ভাড়ার এক সমান্তরাল ব্যবসা। শুধু মাছের পোনা নয়—পাতিল, ব্যারেল, ট্রে, এমনকি মাছ মাপার ডিজিটাল মিটারও এখানে ভাড়ায় মেলে। ব্যারেল বা পাতিল ভাড়া ২০ টাকা, ট্রে ২০ টাকা আর একটি ডিজিটাল মিটার ভাড়া দিতে হয় ১০০ টাকা।
দাসেরহাট বাজারের ব্যবসায়ী মজিবর রহমানের কাছে আছে ২৫০ ব্যারেল, ২০০ পাতিল আর কয়েক ডজন ট্রে। প্রতিদিন এগুলো ভাড়া দিয়েই তাঁর আয় হয় গড়ে ১০ হাজার টাকা।
এখানেই শেষ নয়। বাজারে পোনা পরিবহনের জন্য পানির বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে। দাসেরহাট তাকওয়া জামে মসজিদের পানির হাউজ থেকেই এই পানি সরবরাহ করা হয়। নির্দিষ্ট হারে এরও ভাড়া ধার্য রয়েছে প্রতি ট্যাংকি পানি ১০০ টাকা, ব্যারেলভর্তি পানি ২০ টাকা আর পাতিলভর্তি পানি ১০ টাকা।
সব মিলিয়ে প্রতিদিন শুধু পানি, পাতিল, ব্যারেল আর ট্যাংকির ভাড়াতেই ঘোরাফেরা করে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। ফলে পোনার বাজার ঘিরে এক ধরনের পরিপূরক অর্থনীতি তৈরি হয়েছে, যেখানে মাছের পাশাপাশি সরঞ্জাম ভাড়ার ব্যবসাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আঞ্চলিক অর্থনীতিতে প্রভাব : দাসেরহাটের পোনা মাছের বাজার শুধু ক্ষুদ্র মৎস্য চাষিকে স্বাবলম্বী করছে না, আশপাশের আঞ্চলিক অর্থনীতিতেও ফেলছে বড় প্রভাব। বাজার ঘিরে গড়ে উঠেছে পরিবহন ব্যবসা, শ্রমজীবী, ব্যারেল ভাড়া, খুচরা মাছের খাদ্য বিক্রি আর স্থানীয় রেস্টুরেন্টের জমজমাট বেচাকেনা। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড় এই খাতগুলোকেও সমৃদ্ধ করছে।
আগৈলঝাড়া, গৌরনদী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জের অসংখ্য পরিবার সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই বাজারের সঙ্গে যুক্ত। কেউ পোনা চাষে, কেউ শ্রমজীবী, কেউ সরবরাহে, আবার কেউ সংশ্লিষ্ট খাতের খুচরা ব্যবসায় জীবিকা নির্বাহ করছেন। আগৈলঝাড়ায় কয়েক হাজার মানুষ এই পেশার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন। ব্যবসায়ীদের মতে, দাসেরহাট বাজার ঘিরে বছরে মাছের পোনা বাদ দিয়েই প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার আর্থিক কার্যক্রম হচ্ছে। এ কার্যক্রম দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নগদ অর্থপ্রবাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগও তৈরি করছে।