প্রতিবারই আমন উৎপাদনে শোনা যায় বাম্পার ফলনের খবর। এবার এই প্রাপ্তি যেন একটু বেশিই রঙিন। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেট আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কৃষি প্রযুক্তির নাগাল পেতেন না প্রান্তিক চাষি। এবার সেই দৃশ্যপটে ভিন্নতা। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সেইসব অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে ছাতকের আমনচাষিদের ক্ষেত্রে এবার প্রযুক্তি আর পদ্ধতির উপযোগিতা বেড়েছে বহুগুণ। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলার এই উপজেলায় এবার তাই আমন চাষে ভিন্ন আমেজ।
ছাতক উপজেলায় এবারও রোপা আমন মৌসুমে ভালো ফলন মিলেছে। মূলত কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ, আবাদ পদ্ধতি পরিবর্তনের যে ইতিবাচকতা ছিল, তার প্রয়োগের ক্ষেত্র ছিল সাবলীল। কোথাও কোনো প্রভাবশালীর হাত বাধা হয়নি। কৃষকের চাওয়াই যেন সংশ্লিষ্টদের কাছে ছিল সর্বোচ্চ বিধান। ফলে বদলে গেছে এ অঞ্চলের কৃষকের ভাগ্যচিত্র।
ফসলের মাঠে পোকামাকড় নিধনে নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও উন্নতমানের কীটনাশক প্রাপ্তি ও উন্নত বীজ সহজলভ্য হওয়ায় বেড়েছে ধানের ফলন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠজুড়ে এখন পাকা আমন ধান কাটার ধুম পড়েছে। চলতি শীত মৌসুমের শুরুতেই রোপা আমনের বাম্পার ফলনে অধিকাংশ কৃষক পরিবারে থাকবে উৎসবের আমেজ। এমনটাই জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে ধান ও চালের দামেও কৃষকের পরিশ্রম সার্থক করতে কাজ করছে সরকার।
স্থানীয় কৃষি কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রোপা আমন মৌসুমে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার এলাকায় ধানের আবাদ করা হয়েছে ১২ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে। এসব জমি থেকে প্রায় ৫১ হাজার ১৯৬ টন ধান উৎপাদন হবে বলে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি বিভাগ। ২০২৪-২৫ বছরে রোপা আমন আবাদকৃত ১৩ হাজার ৬০ হেক্টর জমি থেকে ধান উৎপাদন হয় ৫০ হাজার ৪৩০ টন। কাগজে-কলমে আবাদকৃত জমির পরিমাণ কম দেখা গেলেও উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তির দিকে। এবার কৃষকরা সচেতনভাবে কাজ করায় এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়ায় আমন উৎপাদনে এগিয়ে গেছেন।
২০২৩-২৪ বছরে রোপা আমন আবাদকৃত ১৩ হাজার ৫০ হেক্টর জমি থেকে ধান উৎপাদন হয় ৫০ হাজার ৩৮৮ টন। ২০২২-২৩ বছরে আবাদকৃত ১২ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমি থেকে উৎপাদন ছিল ৪৯ হাজার ৭০ টন। ২০২১-২২ বছরে রোপা আমন আবাদকৃত ১৩ হাজার ৬০ হেক্টর জমি থেকে ধান উৎপাদন হয় ৫০ হাজার ৪৩০ টন। অর্থাৎ প্রতি মৌসুমে প্রায় সমপরিমাণ জমিতে আবাদ করা হলেও উৎপাদনে এবার বিগত তিন-চার মৌসুমের চেয়ে এগিয়ে আমনচাষিরা।
বিগত কয়েক বছরে এই অঞ্চলের কৃষকদের উন্নত ফসল উৎপাদনে সহায়তা দিতে সরকারিভাবে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল। অন্য সময় হার্ভেস্টার, বীজ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে লুকোচুরি চললেও এবার ছিল পরিচ্ছন্ন। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ৫১টি কম্বাইন হার্ভেস্টার মেশিন, ২৬টি রিভার মেশিন, ৪২টি ক্রাশার মেশিন, ৩৯টি স্প্রে মেশিন, ১৫টি গার্ডেন টিলার মেশিনসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির প্রতিটিই ছিল কৃষকদের জন্য নিবেদিত।
এবারে রোপা আমন মৌসুমের শুরুতেই বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় উপজেলার মোট ১০০টি ব্যাচে তিন হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মৌসুমের আগে এই পদক্ষেপ সফল হওয়ায় পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামতে পেরেছেন আমনচাষিরা। এরই মধ্যে আমন ফসল বেচাকেনায় কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিতে প্রস্তুতি শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি কার্যালয় থেকে এই মৌসুমে উন্নত জাতের বীজের মধ্যে বিআর-২২, ব্রি-৪৯, ব্রি-৫১, ব্রি-৫২, ব্রি-৭৫সহ ৯ ধরনের ধানের বীজের পাশাপাশি কৃষকরা স্থানীয় জাতের মধ্যে কালিজিরা, চিনিগুড়া, তুলসীমালা, গুটি ইরি, বেগুনবিচি, চেংগারমুড়ি ধানের আবাদ করেছেন। উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের ফসলের মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, কৃষকরা দল বেঁধে ফসলের মাঠে কাস্তে হাতে ছুটে চলেছেন। ধান কেটে অনেকে ফসলের মাঠে মাড়াই-ঝাড়াইর কাজ সেরে নিচ্ছেন। নারীরাও সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন ধান শুকানোর কাজে। এ গ্রামের কৃষক ফারুক আহমদ বলেন, ‘আমি এবার মোট ২০ বিঘা জমিতে রোপা আমনের চাষাবাদ করেছি। আলহামদুলিল্লাহ, এবার ফলন খুব ভলো হয়েছে, আমরা আনন্দিত।’
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, চলতি রোপা আমন মৌসুমে ধান রোপণের আগে ৭৫০ জন কৃষককে বিনামূল্যে উন্নত বীজ সরবরাহের পাশাপাশি উপকারভোগী প্রতি কৃষককে বিঘাপ্রতি পাঁচ কেজি ধানের বীজ, ১০ কেজি ডিওপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিতরণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া ২৫০টি রোপা আমন ক্ষেত প্রদর্শনীর জন্য পুরো উপজেলায় ১০ হাজার কেজি ইউরিয়া সার এবং সমপরিমাণ ডিওপি ও এমওপি সার বিতরণ করা হয়েছে। ছাতক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ তৌফিক হোসেন খান বলেন, এবার আবহাওয়া অনেকটাই অনুকূলে ছিল।























