ঢাকা   শনিবার
০১ নভেম্বর ২০২৫
১৬ কার্তিক ১৪৩২, ০৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

পানির জন্য হাহাকার, ১৯ হাজার বিঘায় বোরো আবাদ ঝুঁকিতে

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:৩৯, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

পানির জন্য হাহাকার, ১৯ হাজার বিঘায় বোরো আবাদ ঝুঁকিতে

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হাওরের ভাটির ইউনিয়ন গোয়ালনগর। যে ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকে, সেই এলাকার মানুষ এখন পানির জন্য হাহাকার করছে। এ ইউনিয়ন দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদীর শাখা চিকনদিয়া ও কাইঞ্জার খাল দুটি এখন প্রায় মৃত। পলি জমে খাল দুটি ভরাট হওয়ায় ১৯ হাজার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ হুমকির মুখে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানি না পেয়ে উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন কয়েক হাজার কৃষক। 

কৃষকদের শঙ্কা–শিগগিরই যদি খাল দুটি খনন না হয়, তবে বোরো মৌসুমে জমি আবাদ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এতে উপজেলার হাওর এলাকাজুড়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। 

মেঘনা নদীর একদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়ন, অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়া ইউনিয়ন। স্থানীয়দের অভিযোগ, গত এক দশক ধরে অষ্টগ্রাম এলাকায় মেঘনা নদী থেকে নির্বিচারে বালু তোলার কারণে নদীপ্রবাহের দিক পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে পলি পড়ে চিকনদিয়া ও কাইঞ্জার খাল দুটি ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে গেছে। এতে চিকনদিয়া খালের ওপর নির্ভরশীল সোনাতলা, ঝামারবালি, কদমতলী, মাইজখলা, শিমারকান্দি ও লালুয়ারটুক গ্রামের এবং কাইঞ্জার খালনির্ভর নোয়াগাঁও, মাছমা, গোয়ালনগর, দক্ষিণদিয়া ও আশানগর গ্রামের জমিতে আবাদ এখন ঝুঁকির মুখে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কাইঞ্জার খালের আওতায় নোয়াগাঁও, মাছমা, গোয়ালনগর, আশানগর, দক্ষিণদিয়া ও রামপুর গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার বিঘা জমিতে চাষবাস হয়। অপরদিকে ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চিকনদিয়া খালের আওতায় সোনাতলা, ঝামারবালি, কদমতলী ও মাইজখলা গ্রামের প্রায় চার হাজার বিঘা জমি আবাদযোগ্য। বোরো মৌসুমে খাল দুটিতে পর্যাপ্ত পানি না থাকলে পুরো জমিই অনাবাদি থেকে যাবে।

রামপুর গ্রামের কৃষক আনন্দ সরকার বলেন, ‘গতবার তিনগুণ টাকা খরচ করে খালে পানি আনার ব্যবস্থা করছিলাম। এবার খালের দুই দিকে পলি মাটিতে ভরে গেছে। পানি না পেলে ধান হবে না। ধান না হলে বাচ্চা-পোলা লইয়া না খাইয়া থাকন লাগব।’

নোয়াগাঁও গ্রামের সঞ্জীব দাস বলেন, ‘কাইঞ্জার খালই আমাদের জীবন। পানি না থাকলে ধান ফলানো যায় না। জেলের জালে মাছ ওঠে না। খাল না খনন হলে কৃষক-জেলে সবাই না খেয়ে মরবে।’

গোয়ালনগর গ্রামের ফাইজুল ইসলামের ভাষ্য, এ বছর অন্তত ১০ হাজার বিঘা জমি আবাদ করা যাবে না। আট হাজার কৃষক পরিবার বোরো ফসলের ওপর নির্ভর করে। খাল না খনন করলে এলাকায় দুর্ভিক্ষ লেগে যাবে।

পাশে থাকা কৃষক কাশেম মিয়া যোগ করলেন, ‘গত বছর ৬ বিঘায় বীজতলা দিছিলাম। পানি পাই নাই, অর্ধেক নষ্ট গেছে। এইবারের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সরকার চায় ধান ফলাই, কিন্তু আমাদের পানির ব্যবস্থা কে করে দেবে?’

সরেজমিনে দেখা গেছে, গোয়ালনগর থেকে আশানগর পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটারজুড়ে কাইঞ্জার খাল পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও চর জেগে উঠেছে। একই অবস্থা সোনাতলা থেকে ঝামারবালি পর্যন্ত চার কিলোমিটার চিকনদিয়া খালেও। খাল শুকিয়ে পানিপ্রবাহ একেবারে বন্ধ প্রায়। 

কদমতলি গ্রামের কৃষক হরিমন দাস বলেন, ‘আমরা এক ফসলে নির্ভরশীল মানুষ। এই ধানেই সংসার চলে। যদি জমি আবাদ না হয়, তবে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে।’

নাসিরনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইমরান সাকিল বলেন, ‘যদি খালগুলোর নাব্য ফিরিয়ে আনা না যায়, অন্তত ১০ থেকে ১৪ হাজার বিঘা জমি অনাবাদি থেকে যাবে। এতে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার মণ ধান উৎপাদন কমে যাবে।’ 

গোয়ালনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আজহারুল হক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসির জেলা অফিসে ঘুরছি, কোনো কাজ হচ্ছে না। গত বছর সেচের অভাবে গোয়ালনগর ইউনিয়নের ১০ গ্রামের অর্ধেক জমি অনাবাদি ছিল। এ বছর দুটি খাল একেবারে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বোরো আবাদ বন্ধ হয়ে যাবে। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীনা নাছরিন বলেন, খাল দুটি খননের বিষয়ে ডিসি অফিসে আলোচনা করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদী। 

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আকাশ দত্ত বলেন, এলাকাবাসী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সুপারিশসহ আবেদন করলে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদরদপ্তরে পাঠানো হবে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সদস্য তোফাজ্জল সোহেল বলেন, খাল ও নদী হারালে শুধু কৃষিই নয়, মাছ ও জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হবে। গোয়ালনগর হাওরবেষ্টিত এলাকা। এখানে জলই জীবনরেখা। এখনই যদি খালগুলো পুনর্খনন না হয়, তাহলে পুরো অঞ্চলের প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়বে।

সর্বশেষ