ঢাকা   বুধবার
১৪ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২, ১৬ জ্বিলকদ ১৪৪৬

জলবায়ু পরিবর্তন: লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখী চাষের সুবিধা ও সম্ভাবনা

মো. লিয়াকত আলী

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১৪ মে ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তন: লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখী চাষের সুবিধা ও সম্ভাবনা

দূর থেকে মনে হচ্ছিল সূর্যমুখী ফুলের সমুদ্র। বিশাল এলাকাজুড়ে হাসিমুখে ফুটে থাকা সূর্যমুখী ফুলের রাজ্য হঠাৎ তৈরি হয়নি। লবণাক্ততার কারণে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার এই জমিতে বছর দুয়েক আগেও আমন ধান ছাড়া আর কিছু ফলানোর কথা ভাবতে পারতেন না কৃষক। আমন ধান কাটার পর মাসের পর মাস খালি পড়ে থাকত কয়েক হাজার বিঘা কৃষিজমি। সেখানেই এখন সূর্যমুখী ফুলের সমারোহ।

স্থানীয় কৃষি অধিদপ্তর ও ব্র্যাক অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক থেকে জানা গেছে, এখানে লবণসহিষ্ণু সূর্যমূখীর জাত হাইসান-৩৩ চাষ হয়েছে পাঁচ হাজার বিঘা জমিতে। কৃষকরা চলতি মৌসুমে উৎপাদন করেছেন ১ হাজার ৮০০ টন সূর্যমুখী, যা থেকে ৬ লাখ ৩০ হাজার লিটার তেল উৎপাদন করা সম্ভব, যার স্থানীয় বাজারমূল্য ১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কৃষকরা সূর্যমুখীর বীজ বিক্রি করেন; পাশাপাশি নিজেরাও তেল ভাঙিয়ে স্থানীয় বাজারে ২৫০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছেন।

শুরুটা হয়েছিল ২০২৩ সালের মার্চে। এই এলাকায় হাইসান-৩৩ সূর্যমুখীর জাত পরীক্ষামূলক চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা কিছুটা লবণসহিষ্ণু। সঠিকভাবে চাষ করলে ভালো ফলন মেলে। ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির অ্যাডাপটেশন ক্লিনিকের উদ্যোগে সূর্যমুখীর বীজ ভাঙানো ও খোসা ছাড়ানোর মেশিন, সৌরচালিত সেচ পাম্প সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি কৃষকদের বীজ সহায়তা, সেচ, পরিবেশের পূর্বাভাস, সার ও বালাই ব্যবস্থাপনা বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হয়। 

কৃষকও বুঝতে পারেন, পতিত জমিতে সূর্যমুখী চাষ অন্য যে কোনো ফসলের চেয়ে বেশি লাভজনক। এটা যেমন তাদের স্বাবলম্বী করতে পারে, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক। জলবায়ুসহিষ্ণু উন্নত কৃষি প্রযুক্তি, পরামর্শ ও সেবার মাধ্যমে কৃষকরা পতিত ও অনাবাদি জমিকে চাষাবাদের আওতায় এবং এক ফসলি জমিকে দুই/তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছেন। 

সূর্যমুখী চাষের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বীজ থেকে তেল উৎপাদন। সরিষার বীজ থেকে তেল করার যেমন মেশিন আছে, চিরাচরিত ঘানিও আছে; কৃষকরা সেই পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল করার সময়। কৃষকরা সূর্যমুখীর বীজ থেকে ভালো মানের তেল উৎপাদন করতে পারছিলেন না। তেলটা হচ্ছিল কালো। কারণ বীজের খোসা না ছাড়িয়ে সরাসরি ভাঙানো হচ্ছিল। এ সমস্যা সমাধানে কৃষকদের কাছে সূর্যমুখীর খোসা ছাড়ানো ও বীজ থেকে তেল ভাঙানোর মেশিন দেওয়া হয়। সূর্যমুখী ফুলের মাঝখানের কালো বৃত্তটি যত বড় হয়, তেলের ফলন তত বেশি হয়।  

উপকূলের পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু সূর্যমুখী চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। জলবায়ু ঝুঁকিতে কৃষকরা যেখানে একসময় কিছুই পেতেন না, সেখানে এখন বাড়তি আয়ের উৎস তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে তৈরি করছে কৃষি অভিযোজনের উদাহরণ। ভবিষ্যতে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় সূর্যমুখী চাষ করার ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সূর্যমুখীর তেল শারীরিক সুস্থতায়ও ভূমিকা রাখে। এতে কোলেস্টেরল কম থাকে, যা হৃদরোগীদের জন্য উপকারী। ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। এ জন্য বাজারে সূর্যমুখী তেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

সূর্যমুখী ফুল যখন একসঙ্গে ক্ষেতজুড়ে ফোটে, তখন নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি হয়। হাসিমুখে ফুটে থাকা সূর্যমুখী ফুলের হলুদ পাপড়িগুলো পাখি ও দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দূরদূরান্ত থেকে বিপুল দর্শনার্থী-পর্যটক সূর্যমুখী ফুলের মন জুড়ানো সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন। এর মাধ্যমে এগ্রো ট্যুরিজমের একটি সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।

সূর্যমুখী ফুল থেকে মধু আহরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। মৌমাছি পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ায়; রাসায়নিক ব্যবহার কমে যায়। মধু সংগ্রহ ও বিক্রির মাধ্যমে কৃষকরা নিরাপদ ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন; অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারছেন। মৌমাছি পালন ও মধু চাষ কৃষকদের জন্য আয় বাড়ানোর নতুন উপায় তৈরি হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় লবণসহিষ্ণু সূর্যমুখী চাষ কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। বাড়তি আয়ের উৎস তৈরির মাধ্যমে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবেন। ধীরে ধীরে পতিত জমির যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন; অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে; কমবে ভোজ্যতেলের আমদানির ওপর নির্ভরতা। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে সারাবছর কৃষককে জলবায়ু সহনশীল কৃষিতে ফেরত আনা গেলেই আগামী দিনে টেকসই ও স্মার্ট কৃষি সম্ভব হবে।

মো. লিয়াকত আলী, পিএইচডি: পরিচালক, জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, ব্র্যাক

সর্বশেষ