কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ধলনগর গ্রামের কৃষক মোহন হোসেন আগাম শীতকালীন সবজি হিসেবে চাষ করেছেন ডন ১২৫ জাতের ফুলকপি। চলছে শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা। সম্প্রতি তোলা সমকাল
চলতি মৌসুমে আগাম শীতকালীন সবজি হিসেবে দেড় বিঘা জমিতে লাউ চাষ করেছেন শামিম আহমেদ। গত দেড় মাসে তিনি সাড়ে তিন হাজার লাউ বিক্রি করেছেন। এতে আয় হয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার টাকা। পাইকারি দরে প্রতিটি প্রথম দিকে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি করেন শামিম। বর্তমানে বিক্রি করছেন ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে। দাম ও আবহাওয়া ভালো থাকলে আগামী দুই মাসে অন্তত আরও তিন হাজার লাউ বিক্রি করবেন। ৪০ হাজার টাকা খরচে দেড় বিঘা জমিতে লাউ চাষ করে তিন লাখ টাকা লাভের আশা করছেন এই কৃষক।
শামিমের মতো কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার অনেক কৃষক এবার মোট ৭৩৬ হেক্টর জমিতে লাউ, করলা, শিম, মুলা, লালশাকসহ হরেক রকম আগাম জাতের শীতকালীন সবজি আবাদ করেছেন। কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তর বলছে, এসব জমিতে প্রায় ১৭ হাজার টন সবজি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে, যার বাজারমূল্য ৭৬ থেকে ৮০ কোটি টাকা। গত বছর এই উপজেলায় শীতকালীন সবজি আবাদ হয়েছিল ৭১৬ হেক্টর জমিতে। লাভ দেখে দিন দিন আবাদ বাড়ছে।
জেলায় সবজি উৎপাদনে দ্বিতীয় কুমারখালী
ছয় উপজেলা নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়া জেলা। জানা গেছে, চলতি মৌসুমে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় এক হাজার ৯৫০ হেক্টর, দৌলতপুরে ৬৪৫ হেক্টর, ভেড়ামারায় ৬৩০ হেক্টর, মিরপুরে ৬০৩ হেক্টর, খোকসায় ১৩৯ হেক্টর এবং কুমারখালীতে প্রায় ৭৩৬ হেক্টর জমিতে আগাম শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে। জেলায় সবজি উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে কুমারখালী।
কৃষক শামিম আহমেদের বাড়ি এই উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামে। একই ইউনিয়নের ধলনগর গ্রামের কৃষক ওমর ফারুক ৪৯ শতাংশ জমিতে লিডার জাতের করলার চাষ করেছেন। তিনি জানান, গত দুই মাসে তিনি প্রায় দেড়শ মণ করলা তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচে চলতি মৌসুমে চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকার করলা বিক্রির আশা তাঁর।
ওমর ফারুক বলেন, চারা রোপণের ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মাথায় করলা ধরতে শুরু করে। তখন প্রতিদিন আট থেকে ৯ মণ করে করলা পাইকারি ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এরপর ধীরে ধীরে ফলন ও দাম কমতে থাকে। এখন প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ কেজি করলা তুলছি। আগামী এক মাসে আরও এক লাখ টাকার করলা বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি। জমির ইজারা, বীজ, সার, পরিচর্চাসহ প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচে তিন মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা লাভ হবে।
চাষ হচ্ছে মালচিং পদ্ধতিতে
গত ২৯ অক্টোবর যদুবয়রা, পান্টি, চাঁদপুর, বাগুলাট ও নন্দলালপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, আধুনিক মালচিং পদ্ধতিতে লাউ, করলা, ঝিঙা, ফুলকপি, মুলা, লালশাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ করেছেন কৃষকরা। কেউ পরিচর্চা করছেন, কেউ ফসল তুলছেন বিক্রির জন্য।
আধুনিক মালচিং পদ্ধতির বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষকরা বলেন, এই পদ্ধতিতে গাছের গোড়ায় বা সবজি ক্ষেতে খড়, পাতা, ঘাস বা প্লাস্টিক শিটের মতো বিভিন্ন উপাদান দিয়ে মাটির ওপরের অংশ ঢেকে দেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখা, আগাছা দমন করা, মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা। গত বছর ১৫ শতাংশ জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষ হলেও এবার হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
যদুবয়রা ইউনিয়নের হাঁসদিয়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম বলেন, আগে কলা চাষ করতাম। এতে খরচ, কষ্ট ও ঝুঁকি বেশি, কিন্তু লাভ কম। সেজন্য কয়েক বছর ধরে লালশাক চাষ করছি। এবার এক বিঘা জমিতে লালশাক আবাদ করেছি। দেড় মাসে এক হাজার ২০০ জোড়া শাক ২৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আরও ৪০০ জোড়া শাক বিক্রি হতে পারে। শাক থেকে প্রতি মাস অন্তর প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়।
মিরপুর গ্রামের কৃষক গোলাম রসুল বলেন, আগে এ চাষ জানতাম না। কয়েক বছর হলো কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে আধুনিক মালচিং পদ্ধতিতে আবাদ করে খুব লাভ হচ্ছে। ১০ শতাংশ জমিতে করলার চাষ করেছি। সপ্তাহখানেক পরেই বাজারে তোলা হবে। ১২ হাজার টাকা খরচে প্রায় ৬০ মণ করলা উঠবে, যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকা।
চাঁদপুর ইউনিয়নের ধলনগর গ্রামের কৃষক মোহন হোসেন ৩৬ শতাংশ জমিতে ডন-১২৫ জাতের আগাম ফুলকপি চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ১৬ শতাংশ জমির দুই হাজার ফুলকপি ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এতে খরচ পড়েছে দুই হাজার টাকা। আগামী এক মাসের মধ্যে অবশিষ্ট জমির প্রায় তিন হাজার ৬০০ ফুলকপি বিক্রি করা হবে।
বিক্রি নিয়ে ঝামেলা নেই কৃষকদের
উৎপাদিত সবজি পাইকারি বিক্রির জন্য কুমারখালী পৌরসভা এবং পান্টি তহবাজারে অন্তত ১৪টি আড়ত রয়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়া সদর ও খোকসা উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহের শৈলকুপা, রাজবাড়ীর পাংশা ও পাবনা সদরের আড়তগুলোতে কৃষকরা সরাসরি বিক্রি করেন। আবার স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীরাও ভ্যান ও তিন চাকার গাড়িতে সরাসরি মাঠে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সবজি কিনে থাকেন।
পান্টি তহবাজারের মিলন সবজি ভান্ডারের আড়তদার মিলন হোসেন বলেন, বাজারে মোট তিনটি আড়ত আছে। সেখানে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার কেজি সবজি বেচাকেনা হয়, যার বাজারমূল্য আট থেকে ১০ লাখ টাকা।
কুমারখালী পৌর তহবাজারের মেসার্স অনীক ভান্ডারের ব্যবস্থাপক আসাদুল ইসলাম বলেন, গত শনিবার তিনি এক হাজার ৭০০ কেজি সবজি কেনাবেচা করেছেন। এখানে তাঁর মতো ১১ আড়তদার আছেন। সব মিলে প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ হাজার কেজি সবজি বেচাকেনা হয়, যার বাজারমূল্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। এখানকার সবজি স্থানীয় বাজারগুলোতেই বেচাকেনা হয়।
উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আগাম সবজি চাষিরা প্রতিবছরই ভালো দাম পান। তবে নানান কারণে এবার একটু বেশিই পেয়েছেন। পরিচর্চা খরচ কম হওয়ায় সব সবজিতেই মালচিংয়ের ব্যবহার বাড়ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাইসুল ইসলাম বলেন, অল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় দিন দিন সবজি চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। এ বছর ৭৩৬ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৭ হাজার টন আগাম শীতকালীন সবজি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
শীতকালীন বা গ্রীষ্মকালীন– সব সময়ে সবজিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনা, পরামর্শ এবং কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয় বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে কৃষকের পাশে থাকতে হবে।























