
বাংলাদেশে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় লাভবান হয় ভারতের জেলেরা। এ সময় অনেকটা বিনা বাধায় বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ ধরতে পারে তারা। ফলে নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাশিত ফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বরং দেশি জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ ছাড়া মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অন্য মাছের সঙ্গে ইলিশ রপ্তানির নামে পাচার, মোকামে আসার আগেই সাগরে হাতবদল, ঢাকায় দাম বাড়লে প্রযুক্তির সুবিধায় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মূল্যবৃদ্ধি, অসম বণ্টন, পক্ষপাতমূলক, অসাম্য ও শোষণমূলক ব্যবস্থা, দাদন প্রথাসহ নানা কারণে ইলিশের দাম বাড়ে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ রকম অসংখ্য তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণাদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা সামছুজ্জামান। একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. আকিমুন হাসান রাফি এবং হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ইফতেখার আহমেদ ফাগুনসহ গবেষণাদলে ছিলেন পাঁচজন।
সিকৃবির রিসার্চ সিস্টেমের (সাউরেস) অর্থায়নে এই গবেষণাকার্য সম্পন্ন হয়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা এবং ভারতের নিষেধাজ্ঞা একই সময়ে হয় না। বাংলাদেশ প্রতিবছর সমুদ্র ও উপকূল এলাকায় ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে। অন্যদিকে ভারতে নিষেধাজ্ঞা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত।
ফলে ১৪ জুনের পর থেকে ৩৮ দিন বাংলাদেশ অংশে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে সহজে কোনো বাধা ছাড়াই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ইলিশ শিকার করে ভারতীয় জেলেরা। ফলে যে কারণে ইলিশ নিধনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তার সুফল পুরোপুরি পায় না বাংলাদেশ। বরং দেশের জেলেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী সময়ে আশানুরূপ ইলিশ মেলে না জালে।
এ থেকে উত্তরণের জন্য ভারতে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ একই সময়ে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে।
গবেষকরা ইলিশ আহরণ থেকে শুরু করে বাজারে সরবরাহ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব এবং ইলিশ বাজারজাতকরণে তদারকি সংস্থার দুর্বলতা ও যথাযথ নজরদারির অভাবের কারণে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও দাদনব্যবস্থাকে ইলিশের দাম বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
জেলে, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা এবং ভোক্তা পর্যায়ে প্রায় ৩১৭ জন ব্যক্তির ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, জেলে থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছতে ইলিশ অন্তত চার থেকে পাঁচবার হাতবদল হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রগামী একটি ট্রলারে ১০ থেকে ১৫ জন জেলে ৮ থেকে ১০ দিন সমুদ্রে থাকলে খাবার, জ্বালানি, বরফসহ সব মিলিয়ে ব্যয় হয় তিন থেকে চার লাখ টাকা। জেলেরা জানিয়েছেন, এ রকম একটি ট্রিপে ২০ মণের (৮০০ কেজি) বেশি মাছ ধরা না গেলে খরচ মেটানোর পর কোনো লাভ থাকে না।
গবেষণাদলের সদস্য মো. আকিমুন হাসান রাফি বলেন, ‘মৎস্য অধিদপ্তরই বলছে, দেশের মোট মাছের ১২ শতাংশের জোগান দেয় ইলিশ। অথচ যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষের পাতে ইলিশ পৌঁছতে পারে না।’
গবেষণাদলে নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা সামসুজ্জামান বলেন, ‘ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় ও আমিষ সরবরাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম।’