ঢাকা   সোমবার
১০ নভেম্বর ২০২৫
২৫ কার্তিক ১৪৩২, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয় সমবায় দিবস

কৃষি সমবায়ের সাফল্যগাথা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ২ নভেম্বর ২০২৫

কৃষি সমবায়ের সাফল্যগাথা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ঢাকা: স্বেচ্ছায় সম্মিলিত হয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য গঠিত মানুষের সংগঠনই সমবায়। প্রথিতযশা বাঙালি কবি ও সমাজকর্মী কামিনী রায়ের ‘পরার্থে’ কবিতার একটি পঙ্‌ক্তি ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’-কে সমবায়ের মূলনীতি হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। সমবায় হচ্ছে অংশগ্রহণকারী জনগণের স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন। এর সদস্যরা যৌথভাবে পরিচালিত সম্পদ ও শ্রমের ভিত্তিতে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য মিলিত স্বার্থে কাজ করে থাকে। সমবায় মালিকানায় সদস্যদের অর্থনৈতিক দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হয়। এটি পরিচালিত হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কর্মসম্পাদনে স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহি সমবায়ের গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সমবায়ের সদস্যরা নিজেরা উৎপাদন করে, ভোগ করে ও বিপণনে অংশগ্রহণ করে। সমবায়ের মাধ্যমে ছোট উদ্যোগগুলো লাভজনক হয়ে ওঠে ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এর অংশীজন বেশি হলে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ হ্রাস পায়। বাজারে দরকষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও তাতে ভালো মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়। উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা যখন মানসম্পন্ন পণ্য ন্যায্যমূল্যে প্রদানে ব্যর্থ হয় তখন সমবায় এর প্রতিকার হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সদস্যদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও আর্থিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বিস্তৃত করা। এছাড়া সামাজিক উন্নয়ন, বৈষম্য হ্রাস, কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য মোচনে সমবায় হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ধরনের সমবায় সংগঠন গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে রয়েছে উপযোগমূলক সেবা, ভোগ্যপণ্য, শ্রম, পরিবহন, বিদ্যুৎ, চিকিৎসাসেবা, শিল্প, গৃহায়ন, সঞ্চয় ও ঋণ প্রদান, বীমা এবং কৃষি উৎপাদন ও বিপণন সম্পর্কিত সমবায়। তন্মধ্যে কৃষি উৎপাদন ও বিপণনবিষয়ক সমবায়ের পরিধি অনেক বিস্তৃত। অংশীজনের সাফল্য খুবই দৃশ্যমান।

কৃষি মানুষের সবচেয়ে পুরনো পেশা। সমবায়েরও আদি রূপ কৃষি সমবায়। এর মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে কৃষক ফসলহানির সংকট কাটিয়েছে, কৃষিতে অর্থায়ন নিশ্চিত করেছে, উপকরণ সহায়তা নিয়েছে, উৎপাদনে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং পণ্য বিপণনে সফলতা পেয়েছে। তাতে কৃষকদের জন্য লাভজনক হয়েছে কৃষির উৎপাদন। কৃষি সমবায়গুলোর মূল উদ্দেশ্য নিম্নরূপঃ

  • উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ হ্রাস;
  • ঝুঁকি উপশমিত করা;
  • প্রতিযোগিতামূলক পণ্যবাজারে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জন;
  • বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অভিগম্যতা প্রাপ্তি;
  • মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস;
  • কৃষি ব্যবসায় লাভজনকতা বৃদ্ধি করা এবং
  • গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।

কৃষিকাজ বলতে বাংলাদেশে ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ফসল ফলানো, খাদ্যশস্য উৎপাদন, পশু-পাখি পালন, মাংস, দুগ্ধ ও ডিম উৎপাদন, মৎস্য চাষ, কৃষি বনায়ন ইত্যাদি সমষ্টিকে বোঝায়। এ বিশাল কার্যক্রমের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে সমবায়। এদের মধ্যে শস্য উৎপাদন ও বিপণন সমবায়, দুগ্ধ সমবায়, মৎস্য চাষী সমবায়, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সমবায়, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের সমবায়ের ক্ষেত্রে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, ভারত ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসব দেশে সমবায়ের বার্ষিক আয় পর্যাপ্ত। অংশীজনের সংখ্যাও অনেক বেশি। জাতীয় উৎপাদন ও কর্মসৃজনে দীর্ঘকাল ধরে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছে কৃষি সমবায়। নিম্নে তার কিছু বিবরণ পেশ করা হলো।

জাতীয় কৃষি সমবায় ফেডারেশন জাপানের ও সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃষি সমবায় সংগঠন হিসেবে বিবেচিত। এর প্রধান দপ্তর টকিওতে অবস্থিত। ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ থেকে এর যাত্রা। বর্তমানে এর বার্ষিক আয় ৪১ বিলিয়ন ডলার। কৃষি খামারগুলোর অর্থনৈতিক মান বৃদ্ধি করা, বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পাশ কাটিয়ে কৃষকদের জন্য পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, কৃষি উপকরণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষকদের জন্য বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং উৎপাদনে নিয়োজিত মূলধন সংগ্রহে সহায়তা করা ওই সমবায় সংগঠনের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। জাপানের হক্কাইডুতে প্রতিষ্ঠিত হকুরেন কৃষি সমবায় ফেডারেশন আরেকটি উল্লেখযোগ্য সমবায় সংগঠন, যার বার্ষিক আয় ১৩ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। সংগঠনটি কৃষকদের উৎপাদন ও বিপণনে সহায়তা করে থাকে। এছাড়া কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও চাষাবাদের মূলধন সরবরাহ করা এ সংগঠনের কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। জাপানি সয়াবিন, চাল, শাকসবজি, ফলমূল, গরুর দুধ ও দই বাজারজাতে সংগঠনটি বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় কৃষি সমবায় ফেডারেশন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষি সমবায় সংগঠন হিসেবে পরিচিত। এর বার্ষিক আয় ৩৮ বিলিয়ন ডলার। ১৯৬১ সালের ১৫ আগস্ট এর প্রতিষ্ঠা হয়। ১ হাজার ১৫৫ সমবায় সমিতি এ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত। এর সদস্য সংখ্যা ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন। কৃষকদের উৎপাদন ও বিপণনে সহায়তা দেয়া এ সংগঠনটির প্রধান উদ্দেশ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনিসোটায় প্রতিষ্ঠিত কৃষি ব্যবসা সমবায় সংগঠন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। এর বার্ষিক আয় ৩১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। এর কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজার ৪৫৫। কৃষকদের উৎপাদনে সহায়তা করা ও নতুন প্রযুক্তি, বীজ, সার, কীটনাশক, জ্বালানি ইত্যাদি যথাসময়ে ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করা সংগঠনটির প্রধান দায়িত্ব। পৃথিবীব্যাপী সদস্যদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত করাও সংগঠনটির কার্যবলির অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য সমবায় সংগঠন হচ্ছে দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষক সমবায়। এর বার্ষিক আয় হচ্ছে ১৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, উন্নত প্রযুক্তি সহায়তা, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের কাজে সংগঠনটি সদা নিয়োজিত। তাছাড়া সদস্যদের উৎপাদিত পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নিশ্চিত করা ও তাদেরকে বীমা ব্যবস্থার আওতাভুক্ত করা সংগঠনটির কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের মিনিসোটায় প্রতিষ্ঠিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সংগঠন হচ্ছে ল্যান্ড ও লেকস। এর বার্ষিক আয় ১৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ৮ জুলাই। সংগঠনটির নিয়মিত সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৯৫৯। এছাড়া রয়েছে ৭৫০ জন অনিয়মিত সদস্য। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত মোট কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজার। উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে পনির, মাখন, দুধ, চকোলেট, ডিম ও পশুখাদ্য উল্লেখযোগ্য।

জার্মানির বে ওয়া পৃথিবীর আরেকটি বৃহৎ কৃষি সমবায় সংগঠন। এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি। এর সদর দপ্তর মিউনিকে অবস্থিত। সংগঠনটির বার্ষিক আয় ১৮ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এটি কৃষিপণ্যের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। দেশে ও বিদেশে সবজি, ফল ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিপণন করা এ প্রতিষ্ঠানটির মূল কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।

ইউরোপের ফ্রিজল্যান্ড কম্পিনা আরেকটি বিশ্বখ্যাত কৃষি সমবায় সংগঠন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। মোট সদস্য সংখ্যা ১৭ হাজার ৪১৩। তাছাড়া রয়েছে ১১ হাজার ৪৭৬ দুগ্ধ খামারি, যাদের অবস্থান জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামজুড়ে। সংগঠনটি সদস্যদের দুগ্ধজাত পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপণন করে থাকে। এর বার্ষিক আয় ১৩ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।

কৃষি সমবায় তথা দুগ্ধ সমবায়ের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছে নিউজিল্যান্ড। সে দেশের ফন্টেরা সমবায় সংঘ লিমিটেড বিশ্বের একটি অন্যতম বৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় হিসেবে বিবেচিত। এর বার্ষিক আয় ১৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। সদস্য সংখ্যা ১০ হাজার ৫০০ দুগ্ধ খামারি। মোট বার্ষিক দুগ্ধ উৎপাদন ২ বিলিয়ন লিটার। এ সংগঠন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুধ, পনির, মাখন, দই ও আইসক্রিম সরবরাহ করে থাকে।

ডেনমার্কে অবস্থিত আরলা ফুডস একটি বহুল পরিচিত খাদ্য সমবায়। এটি মূলত দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮০ সাল। ডেনমার্ক ও সুইডেনে ছড়িয়ে থাকা মোট ১১ হাজার ২০০ সদস্য নিয়ে এর অভিযাত্রা। মোট দুগ্ধ উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিলোগ্রাম। বার্ষিক আয় ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের ১৫১টি দেশে সংগঠনটি দুধ, পনির, মাখন, ক্রিম ও মার্জারিন রফতানি করে থাকে। এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য সংগঠনটিতে ৬০টি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা নিয়োজিত রয়েছে। ডেনমার্কের ৯৫ শতাংশ দুগ্ধ উৎপাদন সমবায় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।

ইসরায়েলে প্রতিষ্ঠিত কৃষি সমবায়ভিত্তিক সংগঠন কিবুজ পৃথিবীর গবেষক ও উন্নয়ন চিন্তকদের দৃষ্টি কেড়েছে। এটি গ্রামীণ সমবায় ও যৌথ খামারের প্রতিভূ। এটি সরকারি মালিকানাধীনে পরিচালিত দেশের সব নাগরিকের কল্যাণার্থে গড়ে ওঠা যৌথ কৃষি সমবায়। এর সদস্যরা সরকার থেকে ৪৯-৯৯ বছরের জন্য জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে থাকে। সদস্যপদ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করতে হয়। ইচ্ছা হলে কেউ তা ছেড়েও চলে যেতে পারে। এর প্রকৃতি সমাজতান্ত্রিক। সদস্যের যোগ্যতা অনুসারে কাজ করে ও প্রয়োজন অনুসারে সেবা গ্রহণ করে। এর ব্যবস্থাপনা গণতান্ত্রিক। এখানে সাম্য প্রতিষ্ঠিত। সদস্যদের জীবনমানও সমান। এর প্রতিষ্ঠা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ১৯০৯ সালে। এখন তা শতবর্ষ পেরিয়ে আরো এক যুগ অতিক্রম করেছে। ২০১০ সালের তথ্য অনুসারে ইসরায়েলে কিবুজের সংখ্যা ২৭০। দেশের শিল্প উৎপাদনের ৯ শতাংশ ও কৃষি উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে কিবুজ। মরুভূমিকে উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণ ও খামার যন্ত্রায়ণের মাধ্যমে সবুজ শস্যের ভাণ্ডারে পরিণত করার ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে গ্রামীণ সমবায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিবুজ।

ভারতে বহুল পরিচিত দুগ্ধ সমবায় সংগঠন আমুল ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। গুজরাট সমবায় দুগ্ধ বিপণন ফেডারেশন লিমিটেড এ সংগঠনটির পরিচালনা কাজে নিয়োজিত। এতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী সদস্য সংখ্যা ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ১৩টি জেলার দুগ্ধ সমবায় ইউনিয়ন, যা ১৩ হাজার গ্রামে বিস্তৃত রয়েছে। ভারতের জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে আমুল শ্বেত বিপ্লব ত্বরান্বিত করে দেশটিকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করেছে। সংগঠনটি প্রতিদিন গড়ে চার-পাঁচ লাখ প্রক্রিয়াজাত দুগ্ধ ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য বাজারজাত করছে। এর বার্ষিক আয় ৭ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড গ্রামীণ সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ সংগ্রহ, দুগ্ধজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের আর্থিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে এর আওতাধীন প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সংখ্যা ২ হাজার ৫১৭ ও ব্যক্তি সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৫৮। এ সমিতির উৎপাদিত পণ্যের ব্র্যান্ড নাম মিল্ক ভিটা। তরল দুধের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি ঘি, মাখন, মিষ্টি ও টক দই, আইসক্রিম, ক্রিম, চকোলেট, লাবাং, রসগোল্লা, সন্দেশ, রসমালাই ইত্যাদি উৎপাদন ও বিপণন করে থাকে। এর বার্ষিক দুগ্ধ সংগ্রহের পরিমাণ ৪ দশমিক ৩২ কোটি লিটার। শেয়ার মূলধনের পরিমাণ ৪৪ কোটি ১৪ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। বার্ষিক নিট লাভের পরিমাণ ১৮৫ দশমিক ৬৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশে বর্তমানে একটি পথিকৃৎ সমবায় সংগঠন হিসেবে কাজ করছে মিল্ক ভিটা।

বাংলাদেশ সমবায়ের এক উর্বর ভূমি। বর্তমানে এ দেশে ২৯ প্রকারের সমবায় সমিতি রয়েছে। মোট সমিতির সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। তাতে অংশগ্রহণকারী সদস্য সংখ্যা প্রায় সোয়া কোটি। এদের একটি বড় অংশ কৃষি সমবায়ের সঙ্গে জড়িত। তারা কৃষিপণ্যের উৎপাদন করছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের নাগপাশ এড়িয়ে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করছে। সমবায়ের মাধ্যমে তারা উন্নত বীজ, সার, সেচ ও কৃষি যন্ত্রায়ণের ব্যবস্থা করছে। সমবায়ী কৃষকরা মিলিত হয়ে মাঠের ফসল সংগ্রহ করছেন, মাড়াই, ঝাড়াই ও সংরক্ষণ করছেন। বন্যা, খরা ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহের সময় তারা একসঙ্গে লড়ছেন। একসঙ্গেই তারা মোকাবেলা করছেন সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈপরীত্যকে। বর্তমানে দেশের কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও গ্রামীণ জীবন উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হচ্ছে সমবায়।

বাংলাদেশে এখন প্রায় সাড়ে নয় কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। আরো উৎপাদন হচ্ছে বিপুল পরিমাণে মাছ, ফলমূল ও পশুপাখি। তাতে সমবায়ী কৃষকদের বড় অবদান রয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদেরকে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। তার জন্য দেশের খাদ্য ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন বছরে গড়ে সাড়ে ৪-৫ শতাংশ হারে বাড়িয়ে যেতে হবে। দেশের প্রায় ৮২ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের পক্ষে এত দ্রুত উৎপাদন বাড়িয়ে যাওয়া খুবই দুষ্কর। এর জন্য দরকার তাদেরকে সংগঠিত করা। আর্থিক ও সামাজিকভাবে তাদেরকে ক্ষমতায়ন করা। সমবায়ের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে। এ লক্ষ্যে সমবায় আন্দোলনকে আরো জোরদার করা দরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা বাড়ানো দরকার দেশের সমবায়ী কৃষকদের জন্য। তাতে কৃষি সমবায়ের ভিত্তি আরো দৃঢ় হবে। সমৃদ্ধিশালী হবে দেশের অর্থনীতি। তবে দেশের সমবায় ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করার জন্য এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার। একে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও দুর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্ত রাখা দরকার।

ড. জাহাঙ্গীর আলম: একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ; সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ (ইউজিভি); সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)

সর্বশেষ